এই সুযোগ হারালে পস্তাতে হবে জীবনভর

মাহবুব কবির
| আপডেট : ২৬ মে ২০২০, ২১:০১ | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০২০, ২০:৫৪
মাহবুব কবির

কানাঘুষা শুনছি চীন থেকে নাকি বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমেরিকা-চীন কনফ্লিক্ট এর বড় একটি কারণ হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশ মুখিয়ে থাকবে এই সুযোগ নেয়ার জন্য। ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি। তো হোয়াট এবাউট বাংলাদেশ?

বিনিয়োগে বিশ্বে একটি কথা বা র‍্যাংকিং ইন্ডেক্স চালু আছে, ‘Ease of doing business’। মানে কোন দেশে ব্যবসা করা কত সহজ। কেউ ব্যবসা শুরু করতে চাইলে সে দেশের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা থেকে অনুমতি, কাগজপত্র, জমি কেনা ইত্যাদি করতে কত দিন বা কত সহজে নেয়া যায়, তার একটা আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং ইন্ডেক্স আছে। সেটা দেখে বিনিয়োগকারীরা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তারা কোন দেশে যাবে।

উইকিপিডিয়ায় দেয়া র‍্যাংকিং অনুযায়ী ১৯০ দেশের মধ্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮ নম্বরে। হতবাক হবার বিষয় ২০১০ সালে আমাদের র‍্যাংকিং ছিল ১১৯ নম্বরে। তার মানে এ ক্ষেত্রে গত ১১ বছরে আমরা অনেক নিচে নেমে গেছি। আমাদের এখানে ব্যবসা করা অনেক কঠিন এখন, সেই ইন্ডেক্স অনুসারে।

নেপাল, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত, পাকিস্তানও আমাদের অনেক অনেক উপরে। ভিয়েতনাম ২০১০ সালে ছিল ৯৩, ২০২০ সালে এসে বিশ্ব র‍্যাংকিং-এ সে ৭০ নম্বর সিরিয়ালে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সব দেশ এগিয়েছে, শুধু আমরা ছাড়া।

আমি ২০১০ সাল থেকে বহু দিন বিনিয়োগ বোর্ডে ছিলাম, যা এখন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে পরিচিত। তখন থেকেই দেখছি, ঢাকায় বহু চেষ্টা করেও একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা যায়নি আজ পর্যন্ত। এখানে এসে বিনিয়োগকারীদের যাতে অফিসে অফিসে দৌড়াতে বা হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে না হয়। তারা যেন এক ডেস্ক থেকে অতিদ্রুত কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, জমির ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, ট্রেড লাইসেন্স, টিন, পরিবেশ সার্টিফিকেট বিনা কষ্টে অতি দ্রুততম সময়ে পেয়ে কারখানা চালু করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।

সব অফিসে একজন করে কর্মকর্তা বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রেষণে প্রেরণের জন্য বারবার পত্র দেয়া হয়েছে। আমি শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন জয়েন্ট ডাইরেক্টর দেখেছি ঢাকা বিডা অফিসে। আর কেউ আসেনি। কেউ আসে না। কারণ এটাকে ক্রিম পোস্টিং মনে করে না কেউ।

চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বোর্ডের কাজ করে দিতাম এক দিনে। অনেককে সামনে চেয়ারে বসে। কিন্তু অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী অন্য অফিস ঘুরে আসার পর, তাদের চোখের পানি, নাকের পানি এক হতে দেখেছি। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই দেশে বিনিয়োগ করতে এসে হু হু করে কাঁদতে দেখেছি বিদেশিদের।

চট্টগ্রামে আমার অফিসে আসার পর অনেক বিদেশি উদ্যোক্তাকে জিজ্ঞেস করতাম, ’তুমি আমার অফিস চিনলে কী করে?’ উত্তরে বলত, ট্যাক্সিওয়ালা। উঠেছ কোথায়? হোটেল আগ্রাবাদে। ট্যাক্সি ভাড়া কত নিয়েছে? ৫০০ টাকা। হোটেল আগ্রাবাদ থেকে বাদামতলির মোড়ে আমার অফিসের দূরত্ব খুব বেশি হলে এক কিলোমিটার। ট্যাক্সি ভাড়া বেশি হলে ৬০ টাকা। পরে যা বুঝলাম, তাকে দুনিয়া ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে।

এত কথা বললাম, শুধু বোঝাবার জন্য, আমাদের দেশে এসে বিদেশিদের অবস্থা কী হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখেছি, ওদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস পাঁচ তারকা হোটেলের মানের। থাকা-খাওয়া, বেড়ানো- সব ফ্রি। এক দিনেই সব কাজ শেষ। ভিয়েতনামেও তাই। পাশের দেশ মিয়ানমারও আমাদের থেকে এগিয়ে।

এবার বলুন, বড় বড় কোম্পানি কি আমাদের দেশে আসবে, নাকি ভিয়েতনাম, মিয়ানমার যাবে? সমস্যা হলো বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল, যা তাদের আইনে করা হয়নি।

তবুও কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার কাছে সময় বেঁধে দিয়ে অফিসার চেয়ে না দিলে, সেই সংস্থা-প্রধানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

বিনিয়োগের জন্য আমাদের দেশে না এসে, শুধুমাত্র সার্ভিসের অব্যবস্থাপনার কারণে অন্য দেশে চলে যাবে বিনিয়োগকারীরা, এটা মেনে নেয়া যায় না। এই সুযোগ হারালে আমাদের পস্তাতে হবে জীবনভর। নেপাল-মালদ্বীপ আমাদের চেয়ে এগিয়ে, আর আমরা পিছিয়ে থাকব, এটা মাথায় নিই কী করে!!

লেখক: অতিরিক্ত সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয় (আইন ও ভূমি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :