বেতনহীন ১০ বছর

প্রতিবন্ধী স্কুলশিক্ষকদের বঞ্চনার শেষ কোথায়?

ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া
 | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০২০, ২২:৩১

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বন্ধুবর কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে প্রেরিত পত্রের এক বিশেষ অংশে তাঁর না-পাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস ছড়ানো হাহাকারের কথা লিখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আঘাত করার একটা সীমা আছে, সেই সীমা অতিক্রম করলে তার নাম হয় অবমাননা’। চিঠির অপর বাক্যে বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন‘ক ফোঁটা অশ্রুর বিনিময়ে ক ফোঁটা রক্ত হয় তোমাদের বিজ্ঞান তা কি বলতে পারে?’

কাজী মোতাহার হোসেন সেই চিঠির প্রতি-উত্তরে কী লিখেছিলেন তা হয়তো জানা নেই। কিন্তু কবির জীবন থেকে নেয়া ওই আক্ষেপগাথা এ দেশের সবচেয়ে অবহেলিত, দারিদ্র্যপীড়িত এবং শিক্ষাবঞ্চিত অটিজমসহ সব প্রতিবন্ধী শিশুর পাশে যারা আলোকবর্তিকা স্বরূপ দাঁড়িয়েছেন, সেই বিশেষায়িত প্রতিবন্ধী স্কুলশিক্ষকদের ক্ষেত্রে আজও তা সমভাবে প্রযোজ্য। যতদূর জানা যায়, কবি তাঁর প্রেমাস্পদের তরে বিরহের প্রকাশ ছিল এই নাভীমূল হাহাকার! কিন্তু প্রতিবন্ধী স্কুলশিক্ষকদের ‘হাহাকার’ দুমুঠো খেয়ে সম্মানের সাথে সমাজে বাঁচার। তাদের এই কিছুই না পাওয়ার করুণ বিলাপের যাত্রা করোনাকালে নয়, এ যাত্রার শুরু আরো ১০ বছর আগে। বিগত বছরগুলোতে সারা দেশে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৬২টি স্কুল এবং সরকারি স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকা এক হাজার ২০০টি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মরত প্রায় ২৮ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী (শিক্ষক-পেশাজীবী ১৭ হাজার ৬৬৮ জন এবং কর্মচারী ১৩ হাজার ৮৫২ জন) সরকারি তরফ থেকে কোনো ধরনের বেতন বা ভাতা বা থোক বরাদ্দ এমনকি সামান্য পরিমাণ সম্মানীও পাননি।

কারোনার ক্লান্তিকালে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকার ইতোমধ্যে ৯২ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পৃথকভাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এনডিডিসহ (নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতবন্ধী) সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ৩ কোটি টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে রমজান উপলক্ষে দেশের ছয় হাজার ৯৫১টি কওমি মাদ্রাসার জন্য ৮ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে এই উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তবে দেশের প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশুদের পাশে থাকা প্রতিবন্ধী স্কুলের বেতনবিহীন ২৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এই বৈরী সময়ে সরকারের তরফ থেকে তাদের জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছে না।

১০ বছর ধরেই স্কুলগুলো শুধু অডিট, পর্যবেক্ষণ আর আশ্বাসের ঘেরাকলে আটকে আছে। এ পর্যন্ত না হলো স্বীকৃতি, না হলো কিছু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুলের এমপিওভুক্তি। কেবলই জীবনভর তাদের শুনতে হচ্ছে ‘হবে’।

প্রতিবন্ধী-বান্ধব এই সরকারের আমলে যদি প্রতিবন্ধী স্কুলশিক্ষকদের কিছু একটা না হয়, তাহলে হয়তো আমৃত্যু এভাবেই তাদের স্বপ্নসাধ হাহাকার হয়ে ঝরবে। কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে এরকম বদ্ধমূল ধারণাই জন্ম নিয়েছে। এ আক্ষেপ তাদের ব্যক্তিক-পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ!

প্রসঙ্গত; বিগত ১১ বছরে শিক্ষা, কর্মসংস্থানগত দিক দিয়ে এ দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এখন অনেকাংশে অগ্রসরমান। এর পেছনের মূল কারণ বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দুটো যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, একই সাথে একীভূত, সমন্বিত ও বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, প্রতি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ কার্যক্রম, চাকরির ক্ষেত্রে বয়স শিথিলসহ বহুল প্রতীক্ষিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষানীতিমালা-২০০৯ কে সময়োপযোগী করে ২০১৯ সালের অক্টোবরে এর চূড়ান্ত অনুমোদন করা। এই নীতিমালার আলোকে সরকারের সিদ্বান্ত ছিল সারাদেশে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও চলমান বিশেষায়িত স্কুলগুলোর মধ্যে হতে প্রতি উপজেলায় একটি করে স্কুলকে স্বীকৃতি প্রদান, পূর্বে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুলকে এমপিওভুক্তকরণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে শর্তসাপেক্ষে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুলগুলোকে এমপিওভুক্তি করা। কিন্তু এর সুফল এখনও মেলেনি।

বিশেষায়িত স্কুলগুলো স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মূলত চারটি। এক. যেসব প্রতিবন্ধী শিশু (মাঝারি ও চরম মাত্রার) বিশেষত এনডিডি অর্থাৎ অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন্স সিনড্রোম ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত, তাদের জীবন দক্ষতার পাশাপাশি নমনীয়ভাবে মূলধারার শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা;দুই. যেসব শিশুর পক্ষে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূলধারায় যাওয়া সম্ভব নয় তাদের আগ্রহ ও সক্ষমতার ভিত্তিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত করা; যাতে পরিবারের বোঝা না হয়ে নিজের জীবন নিজেই পরিচালনা করতে পারে; তিন. যে্সব শিশু চরম ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতার শিকার তাদের সামাজিক জীবন নিশ্চিতকরণে দৈনন্দিন জীবন কার্যাবলি (ডিলএ) শিক্ষা প্রদান করা এবং চার. সাধারণ,একীভূত এবং বিশেষায়িত এই ত্রিমাত্রিক উদ্যোগে দেশের শতভাগ প্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা।

এ লক্ষ্যে সরকার অতীতে কয়েক দফায় স্কুলগুলো অডিট করিয়েছে, স্কুলের যাবতীয় কাগজপত্র জমা নিয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ২০০৯-২০১৬ সাল পর্যন্ত কিছু স্কুলকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে কিন্তু অদ্যাবধি এমপিওভুক্ত করেনি। ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি স্বীকৃতি প্রদান বন্ধ রেখেছে। পুনরায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে স্কুলগুলোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুলোর এমপিও এবং দীর্ঘ বছর স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকা স্কুলগুলোর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে। এই পর্যায়েও চার মাস গত হয়ে গেলো প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীরা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখছেন না। শুধু আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন আর সময়ক্ষেপণহয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ১০ বছর ধরে স্কুলগুলোর কোনো সমাধান না হওয়ার পেছনে মূলত দায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা এবং প্রতিবন্ধী-বান্ধব মনোভাবের অভাব। বর্তমানে যোগ হয়েছে করোনাকাল। এ কারণে আরো কত সময় গড়িয়ে যাবে সেটা কেবল তারাই ভালো বলতে পারবে।

দীর্ঘ সময় বিশেষায়িত স্কুলগুলোর স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্ত না থাকার কারণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ হতে প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা আর্থিক এবং অ-আর্থিক সেবা থেকে বঞ্চিত। এতদিন এসব স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে টিউশনি, কৃষিকাজ কেউবা ছোট ব্যবসা করে কো্নো রকম দিনাতিপাত করতেন। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে লকডাউন থাকায় তারা একদিকে যেমন উপার্জন করতে পারছে্ন না, আবার অন্যদিকে গায়ে শিক্ষক তকমা লাগানোর কারণে কারো কাছে সাহায্যও চায়তে পারছেন না।

শুধু প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী নয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দরিদ্র প্রতিবন্ধী পরিবারগুলোও জীবিকা সংকটে রয়েছে সবচেয়ে বেশি। পত্রিকায় প্রকাশিত বেসরকারি গবষেণা প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন-এর প্রতিবেদনে এসব পরিবারের দুর্দশার চিত্রটি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন মতে, চলমান কভিড-১৯ সৃষ্ট অচলাবস্থায় দেশের ৭৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আয়-উর্পাজন সর্ম্পূণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ভূত পরস্থিতিতে দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মানবতের দিনযাপন করছে। প্রতিবন্ধী পরিবারগুলো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করছে- প্রকট ঋণগ্রস্থতা এবং অপুষ্টি। যেসব পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে তাদের সংকট আরো প্রকট। বিশেষত অটিজমসহ এনডিডি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম থাকায় তাদের মধ্যে করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ঘরবন্দি রাখা এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা দরিদ্র পরিবারগুলোঢ় পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যায় জরিপে অংশ নেয়া ৪৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী ঋণগ্রস্থ।

এমতাবস্থায় ‘বাংলাদেশ অটিজম-প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন’ প্রধানমন্ত্রী বরাবর চারদফা দাবি পূরণের অনুরোধ জানিয়েছে। এক. প্রাথমিক অবস্থায় কমপক্ষে প্রতি উপজেলায় একটি করে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি প্রদান;দুই. ইতোমধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করা;তিন. করোনা সংকটে প্রতিবন্ধী পরিবারগুলো যেন অগ্রাধিকারভিত্তিতে সরকারি ত্রাণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক বরাদ্দকৃত ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা এবং চার. প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য করোনা সংকটে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান।

ফোডারেশনের সভাপতি মো. সীমানুর রহমান তাদের দাবিনামায় আশা প্রকাশ করেন যে, তাদের শেষ ভরসা এখনো প্রতিবন্ধী-বান্ধব সরকারের প্রতি। বিষয়টি ফেডারেশন মানবিক দৃষ্টিতে সুবিবেচনার জন্য পত্রে অনুরোধ রাখেন। আমরাও বিশ্বাস রাখি প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে অচিরেই প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীদের এই ব্যথাতুর যাপিত জীবনের অবসান হবে।

লেখকঃগবেষক-প্রশিক্ষক।চেয়ারপারসন, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :