কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিকল্পনা: ‘গ্রাম হবে শহর’

প্রকাশ | ২৮ মে ২০২০, ০৮:১১

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

কোভিড-১৯ বদলে দিয়েছে আমাদের চিন্তা চেতনা। আমাদের পুরোনো ভাবনাগুলোকে তাই নতুন করে সাজাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নিরাপদ থাকে সে চিন্তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করছে বদলে দিতে, বদলে যেতে। আর তাই পরিকল্পনায় আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হয়ে উঠছে কেন্দ্রবিন্দু।

একটি দুর্যোগ আসতে পারে- ২০০১ সালের দিকে এমন একটি অনুমান অনেকে করেছিলেন। বিশেষ করে ৯/১১ এর পর বায়োটেরোরিজমের দুশ্চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোকে ভাবনায় ফেলে দেয়। গবেষকরা তখন উপায় অনুসন্ধান শুরু করেন এবং সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করেন মহামারি মোকাবেলার। সেখানে নীতিদার্শনিকরাও লিখেছেন কিভাবে একটি ভেন্টিলেটার হাসপাতালে আগত অসংখ্য রোগীদের মাঝে বিতরণ করবেন। অপ্রতুল আইসিইউ বেড যেখানে, সেখানে ডাক্তার কোন রোগীকে অগ্রাধিকার দেবেন ইত্যাদি।

সম্ভাব্য বিপদের কথা চিন্তা করে একটি পরিকল্পনা/রূপরেখা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য করেছিল। কিন্তু সেসব পরিকল্পনা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। সে যাই হোক, এখন আমাদের পরিকল্পনাবিদরা কিভাবে কোভিড-১৯ উত্তর অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা যায় তা নিয়ে ভাবছেন। আর তারই অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘরে ফেরা কর্মসূচিকে নির্বাচন করেছেন।

এর মাঝে আমাদের ভাবনা আরও প্রসারিত হয়েছে। সরকার এখন ৭ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যারা গ্রামে ফিরে গেছে সেই তরুণদের গ্রামে উদ্যোক্তা হিসাবে দেখতে পরিকল্পনা করছেন। এরকম একটি পরিকল্পনা আরও অনেক আগেই আমাদের নেয়া প্রয়োজন ছিল। আমার মতে, গ্রাম হবে শহর-স্বপ্নর বাস্তবায়নে এই পরিকল্পনা পরিপূরক।

গ্রাম হবে শহর পরিকল্পনায় এবার আপনিও যুক্ত হতে পারেন কিন্তু! সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রশংসা পেলেও সবকিছু খুলে দেয়াকে আপনি হয়তো সানন্দে গ্রহণ করছেন না। করোনার গতিরোধ না করে ৩১ তারিখ থেকে সবকিছু খুলছে। সেটাতে সকলের দুশ্চিন্তা। আপনিও চিন্তিত!

আপনার চিন্তা দূর করতে আমি প্রথমে বলতে চাই বেশিদিন ঘরে থাকলে মানুষ বেশি করে অসুস্থ হবে। বরং আমাদের উচিত বাইরে অথবা রোদে কিছুক্ষণ থাকা। এমনকি যিনি করোনা আক্রান্ত তিনিও যেন রোদে কিছু সময় থাকেন। ভালো ফল পাবেন।

রোদে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মিতে করোনাভাইরাস মারা যাবে। আমাদের কাপড় চোপড় রোদে দেয়া দরকার জীবাণুমুক্ত করবার জন্য। ঘরের সব জানালা খুলে দিন। আলো আসতে দিন। সব কিছু খুলে দিলে যা হবে তা হলো গ্রাম রক্ষা পাবে। আর যারা কোনো চাকরি করেন না, তারা এ সময় শিশুদের নিয়ে গ্রামে চলে যেতে পারেন। ১৯৭১ সালে  যুদ্ধের সময় গ্রামে চলে গিয়েছিলো শহরবাসি। গ্রাম তখন হয়ে উঠবে শহর- আপনাদের পদচারণায়। যারা রোগী তারা থাকেন শহরে।  শহরের বিদ্যমান টেনশন থেকে আপনারা বাঁচবেন। নগর এ সময়ে নিজেকে করোনামুক্ত করতে সুযোগ পারবে।

আমার মতে, এই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলো একটি পরিকল্পনা নিতে পারেন। গ্রাম হবে শহর- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নটি বাস্তবায়নে শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য। আর সেজন্য পর্যাক্রমে গ্রামের স্কুলগুলোর উন্নয়ন করতে হবে।

উন্নত বিশ্বর শহরে আছে প্রাক-প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা। একজন শিশু ৪ বছর বয়স হলে সে সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টা কিন্ডারগার্টেনে যাবে। এবং সেটি দুইদিন বা তিন দিন হতে পারে। গ্রামের শিশুরা যদি এই সুযোগ পায় তাহলে গ্রাম হবে শহর অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক দর্শন। সেজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে এই প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা যেতে পারে। এতে মূলত কাজ করবেন নারী শিক্ষক। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে। পরিবার আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করবে।

এখানে শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে, মূল্যবোধ শিখবে, ফলে আজকে যে নৈতিক ও সামাজিক সমস্যা আমরা মোকাবেলা করছি সেটা মোকাবেলা করা আরও সহজতর হবে।

প্রাক-প্রাথমিকের পাশাপাশি গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে একাদশ শ্রেণি খোলা যেতে পারে এবছর। এবং আগামী বছর সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি খোলা যেতে পারে। এতে করে নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং গ্রামের জন্য ৩০% কোটা নারীদের জন্য সংরক্ষিত আছে। সুতরাং নারীর ক্ষমতায়ন সুগম হবে।

অনেক মেয়ে স্কুল শেষ করে কলেজে পড়তে পারে না। কারণ বাবা-মা তাদেরকে এলাকার বাইরে ছাড়তে চান না। ফলে তারা চিরজীবনের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নারীমুক্তির জন্য যেমন মেয়েদের কলেজ পড়বার সুযোগ থাকা দরকার, তেমনি দক্ষ নাগরিক গড়তে এটা প্রয়োজন। 

অনেক যুবক কৃষিতে কাজ করেন। কিংবা একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করেন। ওই যুবক যদি বাড়িতে বসে কলেজ করতে পারেন তবে তারা শহরমুখী হবে না। এতে করে শহরের উপর চাপ কমবে এবং নানা সামাজিক রোগ ও অসুখও বিসুখ থেকে জাতি রেহাই পাবে।

এইসব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্ররা নিয়োগ পাবে। তাতে করে গ্রামে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়বে। শিক্ষার মান উন্নত হবে। এবং এই সব যুবক সংসার চালাবে। তারা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে অবদান রাখবে। তারা বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

এভাবে যদি আমরা চিন্তা করি তবে আরও অনেক সুবিধার কথা বলা যাবে। যেমন বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসরুম তৈরিতে কর্মসংস্থান পল্লী এলাকায় হবে। সুতরাং প্রণোদনার টাকা শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানোতে দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে বিপ্লবাত্মক। সেই বিবেচনায় যদি আরও কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয় তবে কর্মসংস্থান বাড়বে ও উন্নয়ন আরও তরান্বিত হবে।

শহরের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গ্রামকে উন্নত করতে শহর হবে গ্রাম একটি বিপ্লব ঘটাবে বাংলাদেশে। আর সেই ক্ষেত্রে প্রণোদনা বিপ্লবকে তরান্বিত ও অর্থপূর্ণ করবে। জাতিরজনকের স্বপ্নপূরণে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে কি?

আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সকলে বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

প্রণোদনা কেবল শিল্প ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দেয়া হচ্ছে। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকার স্কুলগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে একদিকে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল এবং প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে পাঠাগার নির্মাণ করেছিল মন্দা মোকাবেলা করতে। আজ তার সুফল তারা পাচ্ছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, স্বাস্থ্য সচিব প্রণোদনার আবেদন নিয়ে যাবেন কি? শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বর্তমান সময়ের সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে আশা করি আমরা প্রকৃত উন্নয়ন কি বুঝতে পারছি। বাংলার কৃষকরা আমাদের খাবার তুলে দিয়ে স্বাস্থ্যরক্ষায় অবদান রাখে। তাদের উন্নয়ন তাই নৈতিকভাবে কাম্য। আসুন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কিছুদিন গ্রামে থাকি।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।