রাফির যুদ্ধদিন ও একটি সুপ্তবাসনা

প্রকাশ | ২৮ মে ২০২০, ০৯:০১ | আপডেট: ২৮ মে ২০২০, ০৯:০৫

রবিউন নাহার তমা

১৯৯৯ সালের শুরু। চ্যানেল বলতে একটাই ভালোমতো চিনি সেটা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশন। শুক্রবারের আশায় তখন সারাটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম। অতঃপর দুপুর ৩ টার পবিত্র ত্রিপিটক অথবা বাইবেল পাঠ শেষে উপস্থাপিকা যখন ঘোষণা দিতেন-“শুধী দর্শক এখন দেখবেন... শ্রেষ্ঠাংশে ...’’ আমাদের খুশি আর কে দেখে ‍!

অভিনয়শিল্পী বলতে তখন ভালো চিনতাম রাজ্জাক-ববিতা,শাবানা-আলমগীর,মৌসুমী-ওমরসানি কিংবা সালমান শাহ-শাবনুর। মান্না-চম্পার সিনেমা কদাচিৎ দেখতাম । সিনেমায় মৌসুমী ম্যাম নাচলে আমরা পরিবারের বড়দের সামনে বসে নাচতে না পারলেও মনে মনে নাচতাম । আর শাবানা ম্যাম কাঁদলে তো কথাই নেই ! মা-খালাদের সাথে সাথে আমাদেরও গাল বেয়ে পানি পড়তো। থ্রিলার বা অ্যাডভেঞ্চার বলতে কিছুই ছিলো না।

এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন এলো “দীপু নাম্বার টু”। সিনেমা দেখলাম বললে ভুল হবে । বরং হা করে গেলা যাকে বলে তাই করলাম। দীপু আমাদের সবার হিরো হয়ে গেলো! তারিক,দীপু আর নান্টুর পানির ট্যাংকিতে ওঠার রোমাঞ্চকর কাহিনী, দীপু আর তার বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক (এখানে বুলবুল আহমেদ এর কথা মনে করতেই হয়, বাবার চরিত্রে তার অভিনয়কে আমার দেখা সেরা বাবা চরিত্র এর তালিকায় রাখবো),তারিক আর দীপুর বন্ধু হয়ে ওঠার গল্প আর সবশেষে কালাচিতায় পুরাকীর্তি উদ্ধার অভিযান এবং তারিকের মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সরকার থেকে পাওয়া পঁচিশ হাজার টাকার পুরোটা দিয়ে দেওয়া (তখন দুই টাকা দিয়েই অনেক কিছু পাওয়া যেত)-এগুলো ছোট-বড় সবার মনেই বড় একটা দাগ কেটে দিয়ে যায়।

আশির দশকে মুক্তি পাওয়া ‘পুরষ্কার’ আর ‘ছুটির ঘণ্টা’র প্রায় তেরো বছর পর কিশোরদের উপযোগী এত চমৎকার একটি সিনেমা বাংলাদেশের মানুষ উপহার পায় । আগের দুই সিনেমার রেকর্ড ভেঙ্গে ৮.৯ I MDb রেটিং পাওয়া সিনেমাটি এখনও এতোটাই জনপ্রিয় যে টিভির পর্দায় এই সিনেমা চললে কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক কেউই এর আকর্ষণ এড়াতে পারবে না !

এরপর অনেকবছর আর কিশোরদের উপযোগী এমন কোনো সিনেমা আসেনি যা সবার মনে দাগ কেটে যায়। অবশেষে ২০১১ সালে এলো “আমার বন্ধু রাশেদ”। যথারীতি সেই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর রচনায়  এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের হাত ধরে। ৮.২ IMDb রেটিং পাওয়া এই সিনেমাটিও ছোট-বড় সবার মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ভাগ্নে-ভাগ্নীদের একটা ছোটখাটো দল নিয়ে প্রথমবার মুভিটা দেখি। এরপরেও বেশ কয়েকবার দেখেছি। আবেদন আছে আগের মতই।

এরপরে বাংলাদেশে বলার মত কিশোরদের উপযোগী তেমন কোনো সিনেমা নির্মিত হয়নি। ২০১৭ তে “ আঁখি ও তার বন্ধুরা” মুক্তি পেলেও খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি। গত তিনবছরেও যথারীতি কিশোরদের উপযোগী বলার মত তেমন কিছুই আসেনি। ভালো কিছুর নির্মাণ নেই বিধায় কিশোর-কিশোরীরা তথাকথিত মানহীন ওয়েব সিরিজগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যা তাদের সুস্থ বিকাশের পথে বেশ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

হঠাৎ আশার আলো হিসেবে হাতে পাই একটি বই –“রাফির যুদ্ধদিন”। লেখক মুহম্মদ আনোয়ার আলী। স্যারের সাথে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে দেখা হয়। সৌভাগ্যবশত একটি সৌজন্য কপিও পাই। স্যার বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। তারমধ্যে একটি-“ একাত্তরের উদ্বাস্তু’। বেশ ভালো বইটি। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের শরণার্থী শিবিরের চিত্রটি চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে বইটিতে।

বাংলা একাডেমীর “ধান শালিকের দেশ” পত্রিকাতেও স্যারের অনেক ছড়া প্রকাশিত মোনি”। বর্ণনা কিছুটা দীর্ঘায়িত এবং  রাফিকে দুই এক ক্লাস ছোট মনে হলেও উপন্যাসের গাঁথুনি চমৎকার! মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনার পাশাপাশি আছে চমকপ্রদ কিছু ঘটনার বর্ণনা। বিশেষ করে রাফি আর তার বন্ধু হামজার মুক্তিযুদ্ধ দেখতে যাওয়ার ঘটনা। মুকুল মামা, ফজলু কাকা আর বুলাভাই চরিত্রে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া টগবগে  তরুণদের বর্ণনা।

মুক্তিযুদ্ধে হামজার বাবার শহীদ হওয়া , রাফির বাবার নিজের সহায় সম্পত্তি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে পুড়িয়ে দেওয়া , রাতের আঁধারে পরিবারসহ রাফিদের নানার বাড়ি চলে যাওয়া ,পাকসেনাদের আক্রমণে বিদ্ধস্ত্ব পাবনাবাসীর দলে দলে গ্রামে পালিয়ে আসা ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র যেন একদম চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।

বইটা শেষ করার পর মনে হলো এটা নিয়ে কিশোরদের উপযোগী একটা সিনেমা হতেই পারে। মোরশেদুল আলম কিংবা তৌকির আহমেদ স্যারের মতো গুনী মানুষদের হাতের ছোঁয়া পেলে “রাফির যুদ্ধদিন” হতে পারে অসাধারণ একটি সিনেমা যা আবালবৃদ্ধবনিতা দেখতে পাবে। কিশোরদের মাঝে নতুন আলোড়নের সৃষ্টি হবে। সুস্থ বিনোদন নিয়ে তারা নতুনভাবে নিজেদের সাজিয়ে তুলবে পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে লালন করে গড়ে তুলবে সোনার বাংলাদেশ।

লেখকঃ শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/২৮মে/এসকেএস