আমার ডাক্তার মায়ের চলে যাওয়া ও আমাদের অভিজ্ঞতা

বর্ণা সিদ্দিকা
 | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০২০, ১৮:১৫

গত ২০ থেকে ২৬ মে আমার মা ডা. আমিনা খান (সিনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি), নারায়ণগঞ্জে জনগণকে স্বাস্থসেবা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি নিজ বাসায় আইসলেশনে ছিলেন এবং চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেলে করোনা আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেই আইসিইউতে ঘটে যাওয়া ও আমাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি।

# প্রতি শিফটে (৬ ঘণ্টা দিন ও রাতে ১২ ঘণ্টা) পাঁচজন নার্স একসঙ্গে থাকার কথা। কিন্তু পাঁচজন এসে তিনজন ভেতরে নার্সেস রুমে বসে থাকেন। দুইজন তিন থেকে চার ঘণ্টা করে চলে যায়। পরে আবার দুই-তিনজন আসেন। এভাবে তারা তাদের শিফট ম্যানেজ করে। (সূত্র: ডিউটি নার্স)

এখানে কথা হচ্ছে আইসিইউ এমন একটা জায়গায় যেখানে রোগীর জীবনের অনেক সংশয় থাকে। যারা যখন ডিউটিতে আসে তারা কেউ কারো কাছে ডিউটি হ্যান্ডওভার করে না। হ্যান্ডওভার রেজিস্ট্রার থাকলেও কোনো আপডেট করা হয় না। যা দেখে পরবর্তী জন কোন কাজ করবে তা লেখা থাকে না। এসে রোগীর লোককে জিজ্ঞাসা করে কী ঔষধ পাইছে আর এখন কী পাবে।

এজন্য কখনো রোগীকে ওভারডোজ কখনো আন্ডারডোজ ঔষধ দেয়া হয় । ২০০ এম. জি দেয়ার ডোজ অথচ ২০ এম.জি দিয়ে চলে যায়। আবার কখনো ঔষধ দেয়াও হয় না। ডাক্তার নার্স শূন্য আইসিইউ থাকে অনেক সময়। তাহলে কি তারা ইচ্ছা করে রোগীর জীবন নিয়ে খেলা করছে নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলছেন?

# দু-একজন ডাক্তার ও নার্স ছাড়া আইসিইউ হ্যান্ডেল করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। কোনো ভেন্টিলেটর ও ইনফিউশান পাম্প চালানোর মতো দক্ষতাও তাদের নেই। কারণ কয়েক দিনে যা দেখলাম তা হলো আইসিইউ বেড ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন চালানোর কোনো জ্ঞানও তাদের নেই। তাহলে নাম কা ওয়াস্তে আইসিইউ কেন?

# আমাদের রোগী যে বেডে ছিলেন সেটা ভেন্টিলেশন দেওয়ার জন্য যে সকল সুবিধা থাকার কথা তা ছিল না। বা থাকলেও তা কাজ করছিল না। তাহলে বেড যারা সাপ্লাই দিয়েছে আর যারা এটা গ্রহণ করেছে তারা কী দেখে করেছেন? (সবগুলো নতুন বেড)

যেহেতু বেডটা ভেন্টিলেশনের উপযোগী ছিল না তাই বেড শিফটের প্রয়োজন ছিল। এ সময় তিনি প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট ও রেস্ট লেস অবস্থায় ছিলেন। তখন ডাক্তারের পরামর্শে বেড শিফট করতে গিয়ে এ্যাসপিরেশন হয় এবং উনি কার্ডিয়াক এরেস্ট হন। তখন যিনি ডিউটিতে ছিলেন তিনি সিপিআর দেন ও ৪-৫ মিনিট এর ভেতর রোগী আবার ফেরত আসেন। এক্ষেত্রে কোন কিছুই (ইকুইপমেন্টস) সঠিকভাবে চেক না করেই তাকে শিফট করা হয়। যার ফলে তখন বেডের কাছে কোন অক্সিজেন লাইন কাজ করছিল না। কোনভাবে সেন্ট্রাল লাইন এর অক্সিজেন কাজ করছিল না।

লাইন কেউ লাগাতে পারছিলেন না দেখে আমার ভাইয়া (পলাশ) বলে, ‘দেন আমি চেষ্টা করি’ ও পরে তিনি সংযোগ দিতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে ডাক্তার সফলভাবে ভেন্টিলেশন দিতে সক্ষম হন। তারপর আরও দুইটা লাইন লাগানোর জন্য ভাইয়াকে বললে সেটা করে দেন। তখন ডাক্তার তার ডিউটি আওয়ার শেষ করে চলে যায়।

পরের শিফটে একজন নারী ডাক্তার আসেন এবং বলেন আমি হলে কোন করোনা রোগীকে সিপিআর দিতাম না। আমার প্রশ্ন ডাক্তার হিসেবে না তিনি কি তার মা হলেও দিতেন না? কাজের মধ্যে উনি যেটা করলেন সেটা হলো সিভি লাইন করতে গিয়ে আর্টারিতে লাইন দিয়ে চলে গেলেন। যা ভেইনে দিবেন তা আর্টারিতে দিলেন। উনি তাহলে কি কাজ শিখে আইসিইউর দায়িত্ব পেলেন? এখানে ডাক্তার এর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

অধিকাংশ ডাক্তার আইসিইউতে একবার নিজের চেহারাটা দেখিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে যায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ওয়ার্ড বয়, আয়া তো সে অনেক দূর। নার্সদেরকে বললে ডাক্তার ডাকার নাম করে হাওয়া হয়ে যায় প্রায় ঘণ্টা পর ফিরে।

এরমধ্যে শিফট পরিবর্তন হয়ে যায়। পরের শিফটে যে ডাক্তার আসলেন তিনি ওই নারী ডাক্তারের কাজ নিয়ে প্রশ্ন করলেন। আমাদেরকেও বললেন যে কাজ ভুল হয়েছে। ততক্ষণে ৫-৬ ঘণ্টা হয়ে গেছে। পরে উনি ওটা খুলে দিয়ে আর একটা সিভি লাইন করলেন পায়ে।

# ভেন্টিলেশন দেয়ার দুই দিনের মধ্যে রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ১০০% হয় এবং অন্যান্য শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। ভেন্টিলেশনের রোগীকে কিছু ইনজেকশন ইনফিউশন পাম্পের মাধ্যমে দিয়ে সিডেট ও মাসল রিল্যাক্স করে রাখা হয় যার মাধ্যমে গভীর ঘুমে থাকে। এ দুদিন পর আর অর্ডার আপডেট না করা ও ফ্রেশ অর্ডার না করার কারণে কোনো নার্স পূর্বের অর্ডার ফলো না করে ইনফিউশান পাম্পে যে ইনজেকশন পাওয়ার কথা তা বন্ধ করে দেয়। পরে রোগীর সেন্স চলে আসে পরবর্তীতে নিজেই ভেন্টিলেশন ও এনজি পাইপসহ সবকিছুই খুলে ফেলে। তখন আইসিইউতে কোন ডাক্তার বা নার্স ছিল না। কোন অক্সিজেনও চালু করা যাচ্ছিল না।

অনেক ডাকাডাকির করায় ডাক্তার-নার্স প্রায় ১৫-২০মিনিট পর আসেন। এভাবে অব্যবস্থাপনার ফলে তিনি আবার সংকটাপন্ন হয়ে যান। ফলে পুনরায় ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয় কিন্তু শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আমি নিজে ডাক্তার হয়েও চিকিৎসা-খাতের এ অব্যবস্থাপনা দেখে একটাই প্রশ্ন এ দায় কার? তাই সবার কাছে অনুরোধ যে যে দায়িত্বে আছেন তারা তাদের ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করবেন।

# নিয়মিতভাবে অর্ডার আপডেট তো হয়ই নাই ২০ তারিখের পর ২১ তারিখে আপডেট করেছে। ২৬ মে মা মারা গিয়েছেন। কেউ ২০ তারিখেরটা ফলো করে কেউ ২১ তারিখেরটা। প্রতিদিন অর্ডার শিট আপডেট করা ডাক্তারদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যা মেইনটেন করা জরুরি।

# ইনফিউশান পাম্প চালানোর মতো দক্ষতা নার্সদের তো নাই, দুই একজন ডাক্তারের ছিল। আমাদের রোগীর পাম্পে যে ইনজেকশন পাওয়ার কথা তা কোনোভাবে ফলো তো করা হয়নি। এমন কি আমরা যখন বুঝতে পেরেছি ততক্ষণে ভালো মানুষটার অবস্থার অবনতি হয়ে গেছে। পরে যতটা পাম্প চালানো হয়েছে কোনোটা ঠিকমত কাজই করে নাই। অপারেটও করতে পারে না। বলে সব নষ্ট। তাহলে এ নষ্ট পাম্প কারা দিলো আর কারা গ্রহণ করলো আর কারা অপারেট করলো?

কিছু পরামর্শ

আমরা আমাদের অভিভাবক হারালাম। দেশ ও জাতি একজন দক্ষ ও যোগ্য ডাক্তার হারালো। ঢাকা মেডিকেলের করোনা আইসিইউতে দক্ষ ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ করা জরুরি। করোনা আইসিইউ এ সচল ইকুইপমেন্ট রাখা ও চালানো শেখানো। করোনা আইসিইউতে ডাক্তার-নার্সদের ডিউটিতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা। ডাক্তার ও নার্সদের এত ( ১০০% পিপিই ) নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরও সেবা পরায়ন মনোভাব নিয়ে সেবা নিশ্চিত করা। যেন আর কোনো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

এটা কোন অভিযোগ নয়, আমাদের সবার জন্য একটা সতর্কতা।

লেখক: সিনিয়র মেডিকেল অফিসার; শান্তি অনকোলজি অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :