স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন চাই আমরা, বিএমএ/স্বাচিপ চায় না?

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২০, ০৯:৫৬ | আপডেট: ২৯ মে ২০২০, ১০:০৪

আরিফুর রহমান দোলন

দেশের স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দাবি। কায়মনো বাক্যে আমরা চাইছি দেশের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশ্ব মানের হয়ে উঠুক। স্বাস্থ্যখাতে জেঁকে বসা দীর্ঘকালের অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর হয়ে নতুন দিনের যাত্রা শুরু হোক। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায় অকালে ঝরে না পড়ুক কোনো প্রাণ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত হোক। চাই শতভাগ মানসম্মত ওষুধ, অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদিও সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ হোক বিশ্বমানের।

বিশেষ করে করোনা ভাইরাসজনিত কারণে গোটা বিশ্বে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগই যখন এক নম্বর দাবি তখন আমাদের দেশেও এই বিনিয়োগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক সেটিও আমরা চাইতেই পারি।

তবে সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে সে ভূত ছাড়াবে কে! করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া, সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সুবিধাদির হাল-হকিকত খুঁজতে গিয়ে গণমাধ্যমসহ দেশের নাগরিক সমাজ আরও ভালোভাবে জানতে পারল, বুঝতে পারল ও নিশ্চিত হলো যে সরকারি হাসপাতালগুলো আসলে ফাঁপা। একদিকে অতি নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আর একদিকে মানহীন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করাই যেন সরকারি হাসপাতালগুলোর দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতি যেমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেমনি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি)দুর্নীতির শেখড়ও অনেক গভীরে। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গণমাধ্যমে এসব নিয়ে অল্পবিস্তর লেখালেখি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিভিন্ন সময় সক্রিয় হয়ে স্বাস্থ্যখাতের ওই মাফিয়াদের নানা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

তবে দেশের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে সমান আন্তরিক আছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিক সমাজ চাইছে যেকোনো মূল্যে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি অনিয়মের লাগাম টেনে ধরা হোক।

আশ্চর্যজনক হলেও দেশের চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। একইভাবে আমরা নির্বিকার দেখছি দেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদকে (স্বাচিপ)। মূলত স্বাচিপের মনোনীত প্যানেলই বিএমএর নেতৃত্ব দিচ্ছে।

চিকিৎসা সেবার মান, সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দায়িত্বহীনতাসহ স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিএমএ, স্বাচিপকে কখনও আমরা উচ্চকিত হতে দেখিনি। বরং দেশের জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে সরকার যখন স্বাস্থ্য খাতের অসুখগুলো সারাতে একটু একটু করে নড়েচড়ে বসছে তখন বিএমএ, স্বাচিপ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনৈতিকভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি জেঁকে বসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার করার সরকারি উদ্যোগ তাদের খুবই অপছন্দনীয়।

তাই যদি না হবে তাহলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত একজন সৎ, মেধাবী, যোগ্য কর্মকর্তার নিয়োগের বিরোধিতা স্বাচিপ, বিএমএ করে কীভাবে? কীভাবে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে সিএমএসডির নতুন পরিচালক নিয়োগে ‘অশনি সংকেত’ দেখতে পায় চিকিৎসকদের মর্যাদাশীল সংগঠনগুলো? যেখানে সিএমএসডি পরিচালনায় দুর্নীতি-অনিয়ম বাসা বেঁধেছে বলে গুরুতর সব অভিযোগ দীর্ঘকালের। সেই রকম একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বয়ং দেশের সরকার প্রধান স্বচ্ছতা আনতে পদক্ষেপ নিলেন তখন স্বাচিপ বিএমএ সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সরব হয়ে প্রশাণ করল সত্যি তাদের বড় স্বার্থে আঘাত লেগেছে।

গত ২২শে মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর যৌথ স্বাক্ষরে একটি চিঠি দেওয়া হয় বিএমএ ও স্বাচিপের পক্ষ থেকে। বিএমপি সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী এবং স্বাচিপ সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান এবং মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয় একজন অতিরিক্ত সচিবকে সিএমএসডির পরিচালক নিয়োগ করা একটি অশনি সংকেতের ইঙ্গিত বহন করে। অবিলম্বে প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত সচিবকে সিএমএসডির পরিচালক পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় এই চিঠিতে। একজন চিকিৎসক কর্মকর্তাকে পরিচালক নিয়োগের দাবি করে এই দুই সংগঠন।

২২ শে মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানকে সিএমএসডির পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে সেনাবাহিনীর একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পর্যায়ের কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় থেকে ওই পদে ছিলেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। নিশ্চয়ই তিনি জেনে বুঝে পছন্দ করে একজন কর্মকর্তা বেছে নিয়েছেন। যিনি সিএমএসডির দীর্ঘদিনের দুর্নীতির বাসা ভেঙে দিতে পারবেন এই বিশ্বাসে। এই পদায়নের বিরোধিতা আসলে কীসের লক্ষণ?

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র ঘেটে দেখলাম সেখানে বলা আছে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো-০১. চিকিৎসক ও যে জনগণকে তারা সেবা করেন তাদের মধ্যে সমঝোতা আরও বৃদ্ধি করা এবং সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করা।

০২. জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে অ্যাসোসিয়েশন সর্বাত্মকভাবে কাজ করবে এবং প্রয়োজনে জনস্বার্থবিরোধী যে কোনো পরিস্থিতি প্রতিরোধ করতে নিয়মতান্ত্রিক কর্মপন্থা গ্রহণ করবে।

বিনীতভাবে বলতে চাই বিএমএ তার দ্বিতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে নকল ফেস মাস্ক, নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ নিয়ে গত কয় মাসে কম জল খোলা হয়নি। এই সময়ে বিএমএ, স্বাচিপ কোনো বিবৃতি দিয়ে এই ঘটনায় জনস্বার্থে তাদের করণীয় কী সেই জানান দিয়েছে? বরং নিশ্চুপই থেকেছে। স্বাস্থ্যখাতে গত কয়েক দশক জুড়ে যে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তার বিরুদ্ধে বিএমএকে কখনো মুখ খুলতে দেখা যায়নি। যদি বিএমএ উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করে চলত তাহলে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি শক্তপোক্ত ভিত্তি পেত না, এটি আমাদের স্থির বিশ্বাস।

নিন্দুকেরা হামেশাই বলেন, স্বাস্থ্যখাতের আজকে যে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এর নির্মূল তখনেই করা সম্ভব, যখন বিএমএ এ ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিক হবে।

পেশাজীবী হিসেবে চিকিৎসকরা সবসময়ই আমাদের কাছে পূজনীয়। আর বর্তমান কভিড-১৯ এর মতো ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসা সেবায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে চিকিৎসকরা যেভাবে কাজ করছেন তাতে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, সম্মান আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু বিএমএ তার সাংগঠনিক শক্তি বা ক্ষমতাকে কতখানি দেশের চিকিৎসা সেবার উৎকর্ষে কাজে লাগিয়েছে সেই প্রশ্ন যদি করি তাহলে সেটি কি খুব বেশি অন্যায় হবে? স্বাস্থ্যখাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিএমএ যদি ভূমিকা রাখে তাহলে সংগঠনটি অনেক বড় দেশ  প্রেমের কাজ করবে। কারণ বিএমএ’র-ই সুযোগ রয়েছে সরকারকে সঠিক গাইড লাইন দিয়ে স্বাস্থ্যখাতের ক্রুটি বিচ্যুতিকে সারিয়ে তুলে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবাকে পৌঁছে দেওয়ার।

স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আর সেই সরকারি বিনিয়োগের স্বচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবিটিও সমান প্রাসঙ্গিক। এজন্যই স্বাস্থ্যখাতের সুশাসন এখন আগের চেয়ে বেশি করে চাইছে সব শ্রেণি পেশার মানুষ। বিএমএ, স্বাচিপ জন আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাস্থ্যখাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা রাখবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।