নাম কিয়া

রুহুল আমিন শিপার
 | প্রকাশিত : ২৯ মে ২০২০, ১১:৪৯

নাকের ডগায় ঝুলিয়ে গর্দভকে ভুলিয়ে রাখা যায় এমন এক ধরনের তরকারি আমার বেশ প্রিয়। অতএব আপনাদের মতো আমারও এতে কোন সন্দেহ নেই যে ওই 'তরকারি-প্রীতি' ই আমার নিজ শ্রেণি-পরিচায়ক। তাতে বরাবর আপত্তিরও কিছু দেখছি না। কেননা এই সমাজ-সংসারে 'ভারবাহী' হওয়া বেশ আরামদায়ক। কেউ আপনাকে আঁচড়টি কাটবে না, মোচড়টিও দেবে না।

শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফা ছাড়া গাভী-গাধা নিয়ে কলিযুগে ভেবেছে কোন কাকা? মানস চক্ষের আড়ালে আবডালে আলাভোলা হয়ে নিদান পার করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। সেভাবেই কিন্তু ছিলাম বেশ। সেই রকম নির্বিবাদ পাঁচশালা পরিকল্পনায় একদা এক 'শালা' গরম জল ঢেলে দিয়েছিল।

সে নিজেও ওই সবজির মতো বেজায় লালচে। তবে মুলার মতো হলেও তার মাথা বেশ ভাল। সলিড এবং আয়োডাইজড্। সে আমার সম্পর্কে একটি জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছিল।

আমার ভালো নাম রুহুল আমিন হলে ডাকনাম শিপার হয় কিভাবে? তাই তো? ব্যাপক গুরুতর জিজ্ঞাসা। কোথায় রাজরাণী আর কোথায়....। কোথায় কোলাব্যাঙ আর কোথায় সোনাব্যাঙ। নাহ্, একদম মিলছে নাতো ঠাকুর! তার সন্দেহ আমাকেও মোচড় দিয়েছে ম্যালা! হায়, এমন সঙ্গত প্রশ্ন এর আগে কেউ করেনি কেন? সবাই এতো হাঁদা কেন গো?

তার মতো আমি নিজেও অনেক ঘোরেল মালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটি 'আধুনিক' ডাক নাম নিতে দেখেছি। বুঝলাম সে আমাকেও একই ফর্মুলায় ফেলেছে। আসলে তার গাণিতিক দক্ষতা ইউক্লিড এবং ভাষাজ্ঞান পাণিনির চেয়েও উচ্চতর। মিস্টার মূলাচন্দ্র প্রশ্নখানা সরাসরি আমাকে করলে কিছুটা হলেও বাতচিৎ করতে পারতাম। কিন্তু ও পথে না গিয়ে পানাপুকুরে ঢিল মেরে সে চুপচাপ বসে আছে।

শিপার নামটি রেখেছিলেন আমার বাবা। তিনি ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র ছিলেন। তৎকালে সেখানকার পুলিশ সুপারের ছেলে 'শিপার' ঘটনাক্রমে আমার বাবার ছাত্রত্ব গ্রহণ করেছিল। সেই নামখানা বোধকরি তাঁর মনে গেঁথে গিয়ে থাকবে। ধারণা করি জন্মের পর সেই 'পছন্দ' কপি করে তিনি আমার উপরে সুন্দর মতো পেস্ট করে দিয়েছিলেন। আমিও তো কম যাই না, বরং আরেক কাঠি সরেস। সেই ছেলের নাম ও তার বাপের পেশাটি নিয়ে দিব্যি আমার নিজের পিতার মুখ 'উজ্জ্বল’ (!) করেছি। ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগের পূর্বে তিনি আমাকে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত দেখে গেছেন।

আমার দাদা তার নাতির ভাল নাম রেখেছিলেন খন্দকার রুহুল আমিন-এতোদিন আমি এমনটাই জানতাম। আমার দাদার যা নাম সে তুলনায় রুহুল আমিন ব্যাপক awesome। আমি বরং তাতেই মারাত্মক খুশি ছিলাম। কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ হতে পারতো। অথচ হলো না। পরে দেখলাম এটা রীতিমতো ঐতিহাসিক ব্যাপার।

কদিন আগে আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ। এই কথা সেই কথার পরে অপ্রত্যাশিতভাবে ভাইয়া বললেন, তোমার ভাল নাম রেখেছেন জৈনপুরী পীর সাহেব।

এবার আমি নড়েচড়ে বসলাম। অবাক হয়ে উনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। আর মনে মনে বললাম, বাহ্ আধ্যাত্মিক ব্যাপারতো!

তিনি কিন্তু বলেই চলেছেন, জন্মের পর মামা-মামী তোমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। জৈনপুরী পীর সাহেব তখন বাড়িতে। কেউ তোমাকে পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ওর নাম কী? ওর নাম শিপার। এটা আবার কী নাম? এটাতো ইসলামী নাম নয়। হুজুর আপনি একটা রেখে দেন। বললেন, ওর নাম রুহুল আমিন। ব্যস, সেদিন থেকে হয়ে গেল। 'হুজুরের মতে অমত কার'?

পরবর্তীতে বংশের নাম 'খন্দকার' অবশ্য জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কিভাবে যেন মাধ্যমিকে রেজিস্ট্রেশনের সময় টিকটিকির লেজের মতো সেটাও খসে পড়ে। নাম থেকে খন্দকার বাদ পড়ার বিষয়টি অনেকদিন পর যখন বাবার গোচরীভূত হয় ততদিনে গঙ্গা-যমুনা-পায়রা দিয়ে অনেক জল বঙ্গোপসাগরে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন তাঁর সে কী রাগ! এই দুঃখে কিনা জানি না তিনি আমার মেজ বোনের নামের সাথে খন্দকার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য কাজে লেগেছে। ও মেলবোর্নে স্থায়ী হওয়ায় খন্দকার আন্তর্জাতিক ও একটি কসমোপলিটন রূপ পেয়েছে।

প্রায়ই ভাবনা হয়, জৈনপুরী পীর সাহেব তখন দয়া করে শুধু ভাল নাম খানা এসিল্যান্ডের মতো নামজারি করে দিলে ওই শিপার 'মালটুকু' খন্দকারের মতোই খারিজ হয়ে যেত। তাতে অনেক লাভ হতো। যেমন অকারণে মূলাচন্দ্ররা বিভ্রান্ত হতো না। কিন্তু সেই খারিজ আর হলো কই? আমি নিজে খারিজ হওয়া পর্যন্ত 'তাদের' শুধুই অপেক্ষা।

সেই সবজি এখনো আমার প্রিয় এবং টের পাই আমার মাঝের গর্ধভও আগের মতোই বহাল। নইলে সেই লালটুর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হওয়ার পরও কিন্তু নামের ফয়সালা এখনো মুলতবি।

তাহলে এটার দফা করি কিভাবে? কিভাবে তাকে বুঝাই যে 'শিপার' কোভিড-১৯ র মতো মিউটেশনের মাধ্যমে আসেনি বরং এটি আদি ও অকৃত্রিম। আর সেসব কথা এইবেলা বললেও বা এমন কী ফায়দা? কারণ গাধার কথা শোনে কোন গর্দভ?

লেখক: অতিরিক্ত ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :