মহামারি কবে শেষ হবে?
মহামারি টিকা ছাড়া শেষ হয় না। অথবা এটা এভাবে চলতে চলতে একসময় এনডেমিক বা নিয়মিত ও স্থানীয় রোগে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সহনীয় হয়ে যাবে। কখন সেটা হবে?
নির্ভর করবে যখন রোগটির সংক্রমণ সংখ্যা অর্থাৎ নতুন রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে। সেটা কিভাবে কমে? ধরা যাক একটা ঘরে ১০০ মানুষ আছে এবং এখন রোগীর সংখ্যা ২ জন। মনে করা যাক প্রতি তিন দিনে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুন হচ্ছে। তাহলে ২-৪-৮-১৬-৩২ এভাবে বাড়বে। যেদিন ৩২ জন রোগী ধরা পড়বে সেদিন মোট রোগীর সংখ্যা হবে ৬২। পরদিন মোট লোক বাকি থাকবে ৩২ । তখন রোগটি কমতে থাকবে। কারণ আর লোক নাই।
যারা লকডাউন করে তারা যদি ৪ জনের দিন করে তবে মাত্র ৪ জন দিয়েই রোগ শেষ। আর ৬২ জনের দিন করলে লকডাউন করা আর না করা সমান।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশে কেবল লক্ষণযুক্তদের পরীক্ষা করা হয়। কোনো র্যান্ডম স্ক্রিনিং নাই। না থাকবার ফলে অ্যাসিম্পটম্যাটিক কোন রোগীকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি না। যার জন্য নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না মোট জনসংখ্যার কতভাগ আসলে আক্রান্ত হয়েছে।
যেসব দেশে রেখাচিত্রে অসুখের সংখ্যা পিক বা চুড়া স্পর্শ করে নামতে শুরু করেছে, সেসব দেশে রোগটিকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে এটা কৃত্রিমভাবে আনা হয়েছে।
যেমন চীনের উহানে, কোরিয়ায়, ভিয়েতনামে, শ্রীলংকায়, নেপালে। এরা লকডাউন করেছে, টেস্ট করেছে, ট্রেস করেছে। রোগীদের দ্রুত সমাজ থেকে আলাদা করেছে। যার ফলে সংক্রমণকে কৃত্রিম ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ঠেকিয়েছে।
তাদের মতো করে আমাদের পিক আসবে না। কারন আমরা যথাযথ লকডাউন করি নাই। আমাদের টেস্টিং ও ট্রেসিং দুর্বল। ফলে যারা বলছেন আমরা খুব তাড়াতাড়ি পিকে পৌঁছাব তারা ঠিক বলছেন না। আমাদের পিক আসবে স্বাভাবিক গতিতে ফলে বহু লোক আক্রান্ত হবে, অনেকের দুঃখজনক পরিনতি হবে। আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ২-৪-৮ করে সবচেয়ে দ্রুত অর্থাৎ ৩ দিনের সাইকেলে চললেও বহুদিন লেগে যাবে।
কেবল দিনে ১০০০০ লোক আক্রান্ত হলেই একমাস পরে আমরা কোথাও কোনো হাসপাতালে সাধারণ বিছানাতেও রোগী ভর্তি করতে পারবো না। জায়গা থাকবে না।
মানুষ বেশি হওয়ার কারণে এর মধ্যে জীবানুটির একাধিক মিউটেশন হবার সম্ভাবনাও আছে। আমাদের কপাল খারাপ হলে এটা আরো ভিরুলেন্টও হয়ে উঠতে পারে আবার এর ক্ষমতা কমতেও পারে। কমলে ভালো। যদি বাড়ে? তখন পুরোটাই কপালের লিখন হয়ে দাড়াবে।
তাই আমাদের গ্রাফের চুড়া অনেক উঁচুতে হবার সম্ভাবনা। শুধু তাই না এটা আসবে দেরিতে , আর গ্রাফ যতো উঁচু ও যতো দেরি এটা নামবেও দেরিতে।
“জীবন না জীবিকা” বলে বলে আমরা ঠিকমতো লকডাউন না করাতে , আমাদের অনেক দিন নষ্ট হয়েছে ও রোগটা এখন হবেও বেশি।
করোনার এপিসেন্টার ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তি এলাকাকে ফুল লকডাউন করলে ও সারা দেশে প্রচুর পরীক্ষা করলে এখনও রোগের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা না হলে দুসপ্তাহের মধ্যে এটা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তখন আর কিছু করার সময় পার হয়ে যেতেও পারে।
আর এভাবে চললে ও অফিস আদালত সব খুলে দিলে, আগামী দু থেকে তিন মাস অনেক বেশি বিপদজনক হয়ে উঠবে। তখন সেপ্টেম্বরের আগে করোনা তার উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে হয় না। অন্তত ৭৫ থেকে ৯০ দিন লাগবেই।
আরো বিপদ হবে যদি গ্রাফটা ওপরে গিয়ে কিছুদিন ফ্ল্যাট হয়ে থাকে। যারা বলছেন আমরা পিকে (Peak) পৌঁছে গেছি তারা বোকার স্বর্গে আছেন। এটা কেবল আইসবার্গের সাথে টাইটানিকের ধাক্কা মাত্র। টাইটানিক ডুববে এবং মাঝখান থেকে দুভাগ হবে।
প্রিয়জনদের হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে, মুরুব্বী ও স্নেহময় মানুষদের জীবনের বিনিময়ে , জীবনকে বাদ দিয়ে জীবিকার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অনেকে হবো প্রিয়জনদের হত্যাকারী আর অনেকে আত্মহত্যার মতোই নিজেকে বিপদে ফেলবো।
সাবধানতার তাই আর কোনো বিকল্প নাই। কারন ছাড়া বাসা থেকে বের হবেন না। মাস্ক, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব। দয়া করে নিজে সংক্রমিত না হতে চেষ্টা করুন ও অন্যকে সংক্রমন না দিতে চেষ্টা করুন।
আশা করি এসব কথা সঠিক হবে না। কোন এক দৈববলে সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে। তবে পৌরাণিক কাহিনীতে দেবতার সাহায্য পেতে হলেও নিজেকে হারকিউলিস হতে হয়। হারকিউলিস কিন্তু বুদ্ধি ও শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিল।
হাইড্রার মাথা কেটেছিল তরবারি গরম করে, যাতে রিজেনারেটিং সেলগুলো পুড়ে গিয়ে আর মাথা না গজায় আর মেডুসাকে পাথর করেছিল আয়না দিয়ে, পিওর ফিজিক্স। দেবতার সাহায্য পেতে গেলেও বিজ্ঞান লাগে। বিজ্ঞানচিন্তা বাদ দিয়ে গায়ের জোরে কাজ হয় না।
লেখক: গ্ণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক
ঢাকাটাইমস/৩০মে/এসকেএস