বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
 | প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২০, ১২:১৭

প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং মানবস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিবসটির একটা প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘Tobacco Breaks Your Heart’.

বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরালো করতে ১৯৮৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বছরের একটি দিন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম বছর ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপিত হলেও একই বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলেনে ৩১ মে তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে বিশ্বে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে।

তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনসচেতনতা বাড়াতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারিভাবে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয় না। ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে তামাকবিরোধী জোট দেশব্যাপী জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করে আসছে। সারাদেশে বিগত বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, কর বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় প্রধান্য দিয়ে সভা, সেমিনার, অবস্থান কর্মসূচি, র‌্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে আসছে।

তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার দিনকে দিন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। তামাকের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ গহবরের ক্যান্সার, ডায়াবেটিকস্, এজমাসহ নানা রোগ বাড়ছে। এসব রোগ প্রাণঘাতী, চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। এরপরও দেশের প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। যার মধ্যে কিছু শতাংশ ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করে এবং কিছু শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য যেমন-জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদিও ফুসফুসের অপূরণীয় ক্ষতি করে। এর মধ্যে অতি ৩০ ধরনের ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ধরনের নাইট্রোস্যামিন পাওয়া যায়, যা ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফুসফুস ছাড়াও মুখগহবর, গলনালী এবং পাকস্থলী ক্যান্সারের জন্যও দায়ী এই ধোঁয়াবিহীন তামাক।

বাংলাদেশে সবচেয়ে কম মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য কিনতে পাওয়া যায়। ফলে দরিদ্রদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তামাকের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। সব রকম তামাকজাত পণ্য থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে তার দ্বিগু্ণের বেশি অর্থ তামাকজাত রোগের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করতে হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপান। হৃদরোগের কারণ হিসাবে উচ্চ রক্তচাপের পরেই তামাক ব্যবহারের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক দ্য ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সময়কালে বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর কারণের তালিকায় হৃদরোগ ৭ম স্থান থেকে ১ম স্থানে উঠে এসেছে এবং এই পরিবর্তনের হার প্রায় ৫৩ শতাংশ। আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে তামাকের অবস্থান চতুর্থ।

ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, উপরন্তু যারা তাদের আশপাশে থাকে, তারাও এর ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তারা না চাইলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপান সংক্রামক এবং অসংক্রামক উভয় রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষভাবে শিশু, নারী ও নারীর গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তার কারণে মানণীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন।

তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে তাদের আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে। বর্তমানে দেখা যায় মুদি দোকান থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে। যখন একটি লাইসেন্স দেওয়া হয়, তখন সুনির্দিষ্টভাবে কোন ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সেটা উল্লেখ করা থাকে। তাই মুদি দোকানের জন্য লাইসেন্স নিয়ে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারে না। এক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন ঘটে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যদি তার আওতাধীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয় যে, তারা যে লাইসেন্স দিয়েছে তা সঠিকভাবে তদারকির জন্য, তাহলে তামাকজাত দ্রব্য যত্রতত্র বিক্রয় অনেকাংশে কমে আসবে।

তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও বিপণনের জন্য বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এমনকি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার ব্যবস্থা নাই। এ কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রি হচ্ছে। সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতার কারণে যত্রতত্র তামাকজাত পণ্যের বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। উৎকন্ঠার বিষয় এসব দোকানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রনয়ণ করে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

গত ১৯ মে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের তামাকপণ্য উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন ও তামাকপাতা ক্র-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার এবং তামাক কোম্পানিগুলোকে দেয়া অনুমতিপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী যুগ্ম সচিব মোঃ খায়রুল আলম শেখ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাককে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সহায়ক হিসাবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, তামাক কোম্পানিগুলোকে দেয়া উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে করোনা ভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত অনুমতি প্রত্যাহারসহ সব তামাক কোম্পানির উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন ও তামাকপাতা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

এই বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ২০ মে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা যোগ দেন।

সেখানে আলোচানার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, রাতারাতি এই খাত বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।

এবারের মতো বিড়ি, সিগারেটসহ সব ধরনের তামাক কোম্পানির পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ না হলেও ভবিষ্যতে একদিন বাংলাদেশে সব ধরনের তামাকজাত পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ হবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখকঃ কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইলঃ [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :