সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!

প্রকাশ | ৩১ মে ২০২০, ১৩:৫৫

আরিফুর রহমান দোলন

সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর গণমাধ্যম কর্মীকে রীতিমতো পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে আদালতে উপস্থাপন করে আমাদের অতি সক্রিয়, করিতকর্মা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর সেই একই করিতকর্মা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) হত্যা চেষ্টা মামলার আসামিরা ফুরফুরে মেজাকে ঘুরে বেড়ায় দিনের পর দিন। অতঃপর পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সম্মতিক্রমে দেশও ছাড়ে নির্বিঘ্নে,নিরাপদে।

গণমাধ্যম কর্মী শফিকুল ইসলাম কাজলকে ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বেনাপোল সীমান্ত থেকে উদ্ধার করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরপর অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার, এরপর ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের মতই হাতে হাতকড়া পড়ানো হয়। আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, বিস্মিতও হয়েছি। ভার্চুয়াল জগতে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড়ও বয়েছে। প্রায় দু’মাস নিখোঁজের পর এই সংবাদকর্মীর হঠাৎ আবির্ভাবকে মন্দের ভালো হিসেবে দেখা হচ্ছিল তাৎক্ষণিকভাবে। অনেকেই বলছিলেন, সাংবাদিক কাজলের ফিরে আসাটা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের উপহার। কিন্তু সেই অনুভূতিটি যে ভুল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় হাতকড়া পড়ানোর মাধ্যমে।

খুন, খুনের চেষ্টা, ডাকাতি, জঙ্গি তৎপরতা কিংবা রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করলে হাতকড়া পড়ানো নিশ্চয়ই সঙ্গত। কোনো অপরাধ করলে তার বিচার হোক যথাযথ আইনে, সেটিও আমরা স্বাগত জানাবো।

প্রভাবশালীদের স্বার্থ জড়িত থাকলে পুলিশ এক যাত্রায় দুই ধরনের ফল কেন দেয় সেটিই আমাদের প্রশ্ন।  

হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিশেষ বিমানে দেশ ছেড়েছেন। ২৯ মে সামাজিক গণমাধ্যমে সারাদিন এই খবরই ভাইরাল ছিল। পরের দিন পত্র-পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েও এই সংক্রান্ত খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। তবে মোটেও অবাক হইনি। বিস্ময় জাগেনি। অনেকের মত মুখ টিপে টিপে হেসেছি আমিও। দু’চার জনের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপচারিতায় যেটি নিশ্চিত হয়েছি ছিঁচকে চোর, সন্ত্রাসী ধরা যত সহজ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়া বিত্তশালী, সে যতই অভিযুক্ত হোক না কেন তার টিকিটিও ছোঁয়া নাকি সম্ভব নয়। শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের এমডি, এএমডিকে হত্যা চেষ্টার আসামি দুই ভাই সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক সিকদার, পরিচালক দিপু হক সিকদার উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত থেকে জামিন নেননি। ২৩ মে গুলশান থানায় মামলা হওয়ার পর গুলশানে নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করেছেন ২৮ মে পর্যন্ত। এরপর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বৈধ অনুমোদন নিয়ে রোগী সেজে এয়ার এম্বুলেন্সে করে ঢাকা ছেড়েছেন। এখন বহাল তবিয়তে ব্যাংককের আলীশান হাসপাতালে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর গুলশান থানা পুলিশ বলছে আসামিরা পলাতক? তাদের নাকি গ্রেপ্তার চেষ্টাও চলছে।

সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে সবই সম্ভব। আইনের শাসন এখানে একেক জনের জন্য একেক রকম। দীর্ঘদিন ধরে সুশীল সমাজের একাংশের করা এই অভিযোগ প্রমাণে কেউ কেউ যেন রীতিমতো মরিয়া।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী কারণে অপরাধী, অভিযুক্তের রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক রং দেখে চলবেন সেই প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। পুলিশ সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন সময় যে কথাবার্তা, আলোচনা হয়েছে তাতে অপরাধীর রং বিবেচনা না করার অনুরোধ, উপরোধ, দাবি-ই ছিল প্রবল। আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হচ্ছে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা আদৌ এগোতে পেরেছি কিনা? এই প্রশ্ন যখন ঘুরে ফিরে আসে তার সদুত্তর দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্তের অভাব রয়েছে এখনও।

হত্যা চেষ্টার আসামি রন হক সিকদার, দিপু হক সিকদার কত বড় প্রভাবশালী সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা দেখতে চাই, বুঝতে চাই আইনের হাত সবার থেকে লম্বা এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী।

রীতিমত সিনেমা স্টাইলে একজন ব্যাংক এমডি, এএমডিকে গুলি অতপর জিম্মি করে অপহরণ এবং নিজেদের বাসায় এনে নির্যাতন করে করোনা আতঙ্কের মধ্যে সিকদার গ্রুপের দুই কর্ণধার রীতিমত আলোড়ন তোলেন। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় দেশের ব্যবসায়ী ও ব্যাংকিং মহলে। নড়েচড়ে বসে অনেকেই। সবাই প্রত্যাশা করেন এই ব্যবসায়ীরা যার ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, যারই নাম ভাঙান না কেন উপযুক্ত আইনী ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিমানবন্দর ত্যাগ করার সুযোগ দিয়ে ভুল বার্তা দেওয়া হলো।

পুলিশের  বিশেষ শাখা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা না থাকায় অভিযুক্ত রন সিকদার, দিপু সিকদারকে আটকানো যায়নি তত্ত্ব দিয়ে যতই নিজেদের দায় এড়াক না কেন।

গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে তারাও যে কতটা পারঙ্গম সেই প্রশ্নও উঠল। সব মিলিয়ে অপরাধীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিচয় তার রক্ষাকবচ দীর্ঘদিনের এই প্রচারণার সত্যতাও প্রমাণ হলো।

 ৭ মে এক্সিম ব্যাংকের এমডি, এএমডিকে পাঁচশ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া নিয়ে মতপার্থক্যের জেরে গুলি, অপহরণ, নির্যাতন করেন সিকদার গ্রুপের দুই কর্ণধার, এই অভিযোগ। আর নানা দেন-দরবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগের পর দুই ভুক্তভোগীর অভিযোগ থানা গ্রহণ করে ২৩ মে। এই মামলা নেওয়াই নাকি বিরাট অগ্রগতি!

আমরা প্রায়শই দেখতে পাচ্ছি অনেক বড় বড় অভিযোগ মাথায় নিয়ে আইন, বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগেই বিত্তশালীদের কেউ কেউ আইনের রক্ষকদের নাকের ডগা দিয়ে দেশ ছাড়ছেন ৩০ মে একটি বিশেষ বিমানে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকের মামলা রয়েছে। এমনকি তার দেশত্যাগে দুদকের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার কথা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। কিন্তু আচমকাই বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হলো। তিনি সরকার পরিচালনায় যুক্ত কোনো আত্মীয়ের বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছেন কি না এ নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে নানান ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য আমাদের নজরে এসেছে। সব মিলিয়ে বিষয়টি যথেষ্টই বেমানান লেগেছে।

দুদকের অনুরোধে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় পিপলস লিজিং এ বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত পি কে হালদার, যিনি কিনা তিন হাজার পাঁচশ কোটি টাকা লোপাট করে অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ডুবিয়েছেন। লুটেরা এই পি কে হালদার এখন কানাডায় আয়েশী জীবনযাপন করছেন।

কয়েকশ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, অর্থ পাচার মামলার আসামি বিএনপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল। যতবার পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে ততবার তার নামটি জোরেসোরে সামনে এসেছে। ২০০৯-১০ সালে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছে। সেই লুৎফর রহমান বাদলও বহাল তবিয়তে আমাদের বিমানবন্দর অতিক্রম করে বিদেশে আলিশান জীবনযাপন করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কেরানি’ আফজাল হোসেনের হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য যখন গণমাধ্যমে একের পর এক আসতে থাকে তখন একে রূপকথার গল্প মনে হয়েছিল আমাদের। এরপর দুদকের অনুসন্ধানে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হই। এরপর এই দুর্নীতিবাজের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সকল গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সবাইকে ম্যানেজ করে সেই আফজাল বিমানবন্দর দিয়েই দেশ ছেড়েছেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিলাসি জীবনযাপন করছেন।

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দুদকের মতো একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত সংস্থার অনুরোধ উপেক্ষিত হয় কী করে? গলদটি আসলে কোথায়? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা দুর্নীতিবাজ আফজাল ও তার স্ত্রীর সবকটি পাসপোর্ট দিয়ে বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে দুদক আফজাল দম্পতির দেশত্যাগ ঠেকানোর কথা জানায়। যাদের গাফিলতিতে আফজালদের মতো দুর্নীতিবাজরা এইভাবে দেশত্যাগের সুযোগ পায় তাদের বিরুদ্ধে কখনই দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? আমরা এমন কোনো নজির দেখিনি। যে সমস্ত সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহযোগিতায় ভয়ংকর সব সন্ত্রাসী আর দুর্নীতিবাজরা এইভাবে পার পেয়ে যান তাদেরকেও ছাড় দেওয়া কীসের ইঙ্গিত?

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক সাংসদ ও খালেদা জিয়ার সাবেক একান্ত সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালু দেশের বাইরে আয়েশী জীবন যাপন করছেন। এ কথা আমরা বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। অথচ তিনি দুদকের করা অর্থপাচার, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ একাধিক দুর্নীতি মামলার আসামি। ফালুর তিনশ তেতাল্লিশ কোটি টাকার সম্পদও বাজেয়াপ্ত করেছে দুদক। প্রশ্ন হলো এ রকম একজন আলোচিত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি কীভাবে অতি সহজে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন?

এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু বেসিক ব্যাংকের তিনশ কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পালিয়ে গেছেন। ঋণ কেলেঙ্কারিতে তার নাম আসার পরে দুদক তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কেন বেলায়েত হোসেন মিঠুকে আটকানো গেল না সেই রহস্য আমরা জানতে চাই। টিপু সুলতান, জহির আহমেদ নামের দুই ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী অগ্রণী ব্যাংক ও পিডিবিএল এর পাঁচশ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একই কায়দায় বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এইভাবে অনেক স্বীকৃত দুর্নীতিবাজ, শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়েই বুক ফুলিয়ে দেশ ছেড়েছেন।

আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা সত্যি বিশ^মানের। ভয়ংকর সব জঙ্গিদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা, জঙ্গিদের সব নেটওয়ার্ক তছনছ করে দেওয়া, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পুরোপুরি দমন করাসহ অনেক নিখুঁত তদন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করার কৃতিত্ব রয়েছে তাদের। সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ানো আলোচিত মামলার আসামিদের খুঁজে পায় না এই কথাও আমাদের শুনতে হয়! আর পুলিশের খুঁজে না পাওয়া সেই অসামিরাই আবার পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যদের আতিথেয়তা নিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন।

সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! দিজেন্দ্র লাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ঘটনা। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার অবিভক্ত ভারতে প্রবেশ করার পর এর বৈচিত্র দেখে তার সেনাপতি সেলুকাসকে উদ্দেশ করে যে উক্তিটি করেছিলেন এত বছর পরও যে কত প্রাসঙ্গিক আমরা হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি। তবে জনগণকে বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টা কখনই সফল হয়নি। জনগণ সব দেখে, বোঝে, জানে এবং সময় মতো উত্তরও দেয়। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের বিষয়টি ভুলে না যাওয়াই শ্রেয় হবে।     

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।