জনপ্রতিনিধি-আমলাদের দূরত্ব কাম্য নয়

ড. কাজী এরতেজা হাসান
 | প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২০, ২০:২৫

আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করেন, অনেকে ক্ষমতার দাপটও দেখান। তারা সব সময় চান আলাদা গুরুত্ব, আলাদা মর্যাদা, বাড়তি সুযোগসুবিধা। এই বাড়তি মর্যাদা ও সুযোগসুবিধা ভোগ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলেন। অথচ তাদের সেটা করার কথা নয়। জনসেবা, জনকল্যাণ, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করাই যাদের একমাত্র কাজ হওয়ার কথা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা রাষ্ট্রের এসব স্থায়ী কর্মচারীদের ইংরেজিতে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনগণের চাকর। তাদের একমাত্র কাজ জনগণের সেবা করা। কারণ তাদের বেতন-ভাতা হয় সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়।

উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা। আর সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। এদের আমলা বলা হয়। ‘আমলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন। শব্দগতভাবে তাই যে সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন করে তাদেরকে আমলা বলে। এই আমলাদের সংগঠন বা আমলা-সমাজের নাম বুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবার সর্বপ্রথম আমলাতন্ত্রকে একটি আইনগত ও যুক্তিসংগত মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী, আধুনিক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র প্রশিক্ষিত প্রশাসক এবং কর্মীদের একটি সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত। যার মাধ্যমে যুক্তিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আধিপত্য গড়ে ওঠে কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে।

তবে আমরা অভিধানে বর্ণিত কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার আলোকে উপস্থাপিত ‘আদর্শ আমলা’র সন্ধান বড় বেশি পাই না। আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখি আমলা হচ্ছে সরকারি চাকরি করা বড় বড় পদবীধারী ক্ষমতাধর মানুষ। যাদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে যেতে পারে না। তাদের স্যার, মহোদয় ইত্যাদি সম্মানসূচক বিশেষণ যোগ করে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে সম্বোধন করতে হয়। তারা সব সময় একটা অদৃশ্য প্রাচীর রচনা করে চলেন। যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে আমলারা সবসময়ই একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তির চরিত্র। যাদের মানুষ সমীহ করে, কিন্তু বড় বেশি ভালোবাসে না!

আমাদের দেশে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার মতো এই আমলাদের অনেকের মধ্যেও ‘গণশত্রু’ হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে! এটা রাষ্ট্র সমাজ, সরকার কারও জন্যই শুভ নয়। আমলাদের জন্যও নয়। আমলাদের নিজের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। নিজেদের ‘আচরণ’ বদলানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমলাদের সম্পর্কে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ’। তিনি আরও বলেছিলেন, আমলারা সম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বের পূজারি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এই আমলাসমাজ। লেনিনও আমলাদের সম্পর্কে একই রকম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র তার নখদন্ত প্রবলভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য দেখে অনেকে একে ‘আমলাশাহীও বলে থাকেন। মিশেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র তখন গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে তোলে। আমাদের দেশে আমলাদের তেমন রূপই আমরা বার বার দেখি। তাই তো অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশ তো মন্ত্রীরা চালান না, আমলারা চালান’।

এই করোনা সংকটকালে সরকারি আমলাদের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগও করেছেন। সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে প্রশাসনে চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেক সচিবই মন্ত্রীদের পর্যন্ত গুরুত্ব দেন না। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে। এতে উপেক্ষিত মন্ত্রী দুঃখ করেন রাজনৈতিক মহলে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত। তারা বর্তমান পরিচয় দিতে চান না। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতো করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে এর ডালপালা আরও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। এতে সরকারের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের আজকের এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক নেতারাই অনেকাংশে দায়ী। আমলাদের এমন দাপুটে অবস্থার কারণে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা সংকটকালে এ ধারা আরো বেশি দেখা গেছে। ফলে আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে।

এই দূরত্বের ফলে সুযোগ বুঝে আমলারা আবারো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে বলে আশংকাও প্রকাশ করছি। কেননা অতীতে আমরা এমন অনেক ঘটনটাই দেখেছি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এক রাতের মধ্যেই ৩১ জেলায় ডিসি এবং এসপি'র রদবদলের ঘটনায় সরকারও পরিবর্তন হয়েছিল। এখনো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে স্বাধীনতা বিরোধী মনোভাবাপন্ন জামায়াতের আদর্শের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। তারা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। সুযোগ পেলেই বর্তমান সরকারের অর্জিত সম্মান ক্ষুণ্ন করতে উঠেপরে লেগে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পর্যন্ত এই আমলাদের একটি অংশ অবমাননা করেছিল। তখন আদর্শিক কারণেই মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলাম স্বপ্রণোদিত হয়ে। এইসব জামায়তপন্থী আমলাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আপনাদের আরো একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, ত্রাণ কার্যক্রম থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জনপ্রতিনিধিদের উপেক্ষা করে আমলাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারপরও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কমেনি। দিনমজুর ও কর্মহীন মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ২ হাজার ৫০০ টাকা ঈদ উপহারের তালিকা দেখলেই তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হবে।

আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমলারা যদি এতই নিষ্ঠাবান ও সৎ হন তাহলে সাম্প্রতিককালে করোনা সংকটের সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ৮ মে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে ''মতপ্রকাশের নামে সরকারি কর্মকর্তারা তো গুজব ছড়াতে পারেন না!'' লেখাটি লিখেছিলাম। সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলাম যে, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা এই পরিপত্রের বিরোধিতা করছেন তারা আদতে সরকার বিরোধী এবং সরকারের মধ্যে থাকা জামায়াত-বিএনপির আদর্শপুষ্ট। কেননা তারা চান রাষ্ট্রীয় এই দুর্যোগের সময়ও দেশের ক্ষতি করতে। তা না হলে তারা নিশ্চিতভাবে সরকারি চাকরি করেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা , জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মানহানি করা, জনমনে অসন্তোষ ছড়ানো যাবে, ভিত্তিহীন অসত্য তথ্য প্রচার করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যেই চরিতার্থ করতে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি এমন কাজে লিপ্ত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তো অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন হয়ে পরবে। কেননা, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাই সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই পরিপত্রের নির্দেশনা মেনে চলে দেশকে এই দুযোর্গ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা করোনা মোকাবিলায় সফল হতে পারবো, ইনশাল্লাহ।

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, অগণতান্ত্রিক সরকার আমলানির্ভর। সামরিক বা আধাসামরিক সরকার যারা বাহুবলে বলীয়ান কিন্তু জনসমর্থনের দিক থেকে দুর্বল, তেমন সরকার চায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কর্মকর্তাদের নিজেদের পক্ষে রাখতে। কর্মকর্তাদের বশে রাখার অন্যতম উপায় ঘন ঘন পদোন্নতি দেওয়া। আজ বাংলাদেশে উঁচু পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা বিপুল। পদ নেই, তবু প্রমোশন। গণতন্ত্রের জন্যও জিনিসটি ক্ষতিকর। নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যত অর্থনৈতিক উন্নয়নই করুক, জনগণের কল্যাণ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিকভাবেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারীও সমালোচনা খুব সাদরে গ্রহণ করেন। আমরা জানি সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন দক্ষ আমলাতন্ত্র। সেই আমলাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসাবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন, কোনো ধরণের ষড়যন্ত্রে জড়াবেন না; এমনটাই কাম্য।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক: দৈনিক ভোরের পাতা ও ডেইলি পিপলস টাইম।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :