প্রসঙ্গ: মহামারি ও প্রতিরোধ
অনেকেই স্প্যানিশ ফ্লু এবং প্লেগের ইতিহাস ও পাশবিক অনাক্রম্যতা বা হার্ড ইম্যুনিটি নিয়ে কথা বলছেন। এটা হলে অসুবিধা কি? আমি এটাকে পাশবিক অনাক্রম্যতা ইচ্ছা করেই বললাম।
মানবজাতি আজ পর্যন্ত কোনো রোগের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবে (টিকা ছাড়া) পাশবিক অনাক্রম্যতা বা পশুপালের মতো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে নাই।
প্রাচীনকালে মানুষ গোত্রে বাস করতো। দূরে দূরে বসবাস করতো। তাই কোথাও প্লেগ বা বসন্ত দেখা দিলে তারা সেখান থেকে অসুস্থদের সরিয়ে ফেলে আলাদা তাবুতে রাখতো কিন্তু নিজেরা কেউ এলাকা থেকে বের হতো না। রোগীদের সংস্পর্শে না এসে সাবধানে থাকার চেষ্টা করতো।
ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কমতো আবার রোগ অন্য জায়গায় ছড়াতো না। রোগ নিশ্চিহ্ন হতে সময় কম লাগতো। এটাই আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন। তখনো শহরে লোক বেশি মরতো। রোম, লন্ডন এ প্লেগের মৃত্যু বেশি ছিল কারণ সেখানে মানুষ বেশি ছিল।
স্প্যানিশ ফ্লুর সময় বেসরকারি বিমান চলাচল ছিল না। এত বিমানবন্দর ছিল না। এত পর্যটন ছিল না। এত মানুষ ছিল না। হজ করতে এখান থেকে মুম্বাই গিয়ে জাহাজ ধরতে হতো। আমেরিকা যেতে হলে জাহাজ ধরতে হতো লন্ডন হয়ে সাদাম্পটন বন্দরে গিয়ে।
হার্ড ইম্যুনিটিতে দুটো বিষয় জরুরি। এক হলো বিরাট জনসংখ্যাকে অল্প সময়ে আক্রান্ত করতে পারা। আর আক্রান্তদের সকলকে সঠিক চিকিৎসা দিতে পারা। প্রথমটা সম্ভব কিন্তু প্রথমটা সম্ভব করলে দ্বিতীয়টা কখনোই সম্ভব না।
এটা অল্প কিছু লোকের মধ্যে সম্ভব হতে পারে , টিকা ছাড়া অনেক মানুষের মধ্যে হার্ড ইম্যুনিটি, কার্যকর সমাধান না।
এটার একটা সূত্র আছে। এটা হলো Pc = (1 - 1/Ro)১০০%
এখানে Pc হলো মোট শতকরা জনসংখ্যা যাদের আক্রান্ত হতে হবে। Ro হলো একজন লোক মোট কতজনকে গড়ে আক্রান্ত করে। করোনাভাইরাসের বেলায় এটা ১.৪ থেকে ৩.৯. অর্থাৎ গড়ে একজন প্রায় দেড় থেকে ৪ জনকে আক্রান্ত করে। তারমানে Pc ২৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ।
কাদের ১.৪ হয়, যারা লকডাউন করে , টেস্ট করে ট্রেস করে, রোগটির কার্ভকে প্রায় ফ্ল্যাট করে ফেলেছেন। লড়াইটা হলো রোগটিকে ১ জন থেকে ১ বা তার নিচে সংক্রমনের হারকে নিয়ে আসা।
বাংলাদেশে আমরা সেটার কিছুই করতে পারি নাই। ভাইরাসের পিঠ চুলকে ছেড়ে দিয়েছি। ফলে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ লোককে সংক্রমিত হতে হবে ধরে নিলে এবং মোট জনসংখ্যার হিসাব ১৬ কোটি ধরলে এটা হবে ১১ কোটি ২০ লাখ।
করোনা থেকে মৃত্যুহার সর্বনিম্ন ০.৩ শতাংশ হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৩ লাখ ৩৬ হাজার। ২শতাংশ হলে ২২লাখ ৬০ হাজার। ইটালিতে ৭ শতাংশ হয়েছিল কিন্তু। তাই এটা কোন সঠিক সমাধান নয়।
হার্ড ইম্যুনিটি মানুষের বেলায় চিন্তা শুরু হয়েছিল মাম্পস রোগ দিয়ে। টিকা ছাড়া কিন্তু আমরা মাম্পসকে রোধ করতে পারি নাই। হার্ড ইম্যুনিটির যতো উদাহরণ সব টিকার মাধ্যমে হয়েছে।
টিকা ছাড়া হার্ড ইম্যুনিটি অর্জনের চেষ্টা করতে পারে কোন দ্বীপ বা সুরিনাম , আইসল্যান্ড বা ভুটানের মতো কম জনসংখ্যার দেশ।
পশুপাল বা মুরগীর খামারে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সহজ। লাখ লাখ গরুকে মেরে ফেলে ম্যাড কাউ ডিজিজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লাখ লাখ মুরগী আমরাও মেরে মাটিতে পুতে ফেলেছিলাম বার্ড ফ্লুর সময়। চীন সোয়াইন ফ্লুর সময় লাখ লাখ শুকর মেরেছিল।
টিকা ছাড়া হার্ড ইম্যুনিটি সেরকমই এক অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপ। একসাথে অনেক লোক অসুস্থ হলে করোনাতে মানুষ মরবে না শুধু , তারা সব হাসপাতালে এত পরিমানে থাকবেন যে অন্যান্য রোগের রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা এরই মধ্যে আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
কিছু লোক বলছেন তরুণরা কম মরে। তাই তাদের মধ্যে এটা ছড়ালে কোনো অসু্বিধা নাই। এটাও ভুল। তরুণ বেশি হলে তারা হয়তো শতকরা হারে কম মরবে কিন্তু বেশি জনসংখ্যার দেশে সেটা অনেক। আর তখন দেশের বয়স্করা অধিক মাত্রায় আক্রান্ত হবেন ও বেশি বিপর্যয় হবে।
লকডাউন কিভাবে তোলে? লকডাউন ধাপে ধাপে তুলতে হয়। রোগের আক্রান্ত হবার গ্রাফটি নিম্নমুখী হতে হয়। সবচেয়ে ভালো হলো যদি এটা ফ্ল্যাট হয় বা ১ এর খুব কাছে বা নিচে চলে যায়। লকডাউন তোলার আগে বহু বহু টেস্ট ও ট্রেস করার সক্ষমতা থাকতে হয়।
এসবই বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞান বাদ দিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমরা তো ঠিকমতো লকডাউনই করি নাই।
তাহলে জীবিকার কি হবে? জীবিকারও বিজ্ঞান আছে। সেটা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা কথা বলা দরকার। আমরা সাধারণ মানুষরা যতটুকু বুঝি সেটা নিয়ে পরে লিখবো।
সমাধান কি সেটাও লিখবো। বুঝলে বুঝবেন না বুঝলেও বুঝবেন। কেউ দেখে শেখে। কেউ ঠেকে শেখে।
ঠেকে শেখাটা মাঝে মাঝে খুব খরচের বিষয় হয়ে দাড়ায়।
লেখক: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক
ঢাকাটাইমস/১জুন/এসকেএস