করোনায় সতর্ক সুখেন

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২০, ১৩:২৪

আসুন একটু গল্প করি- সুখেনের গল্প। কিংবা বলতে পারেন নিছক খোশগল্প। করোনার আকালে কারো মন ভালো নেই, থাকার কথাও নয়। সবাই কেমন নির্জীব ম্যাদা মেরে গেছে একেবারে। সুখেনের অবস্থাও তাই তার মনে সুখ নেই, আসুন সুখেনের দুখের গল্প শুনি।

সদা সতর্ক সুখেন করোনাকে বেজায় ভয় পায়। করোনার কথা উঠলেই তার দম আটকে আসে, ঢোক গিললে সে গলায় বাড়তি চাপ অনুভব করে, মনে হয় যেন সাঁড়াশি দিয়ে কেউ তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। গলাব্যথার প্রতিকার হিসেবে সে প্রতি ঘণ্টায় গরম পানি গেলে, তাতে একটু ধাতস্থ হয় সুখেন। এই ভেবে আশান্বিত হয় যে, এযাত্রা হয়তো সে বেঁচে যাবেÑ গরম পানির গতিকে। বেঁচে উঠলে সুখেন কয়েকটা কাজ অন্তত করবে। সে আর কাউকে ঠকাবে না, মিছে কথা বলবে না, অযথা কারো নিন্দেমন্দ করবে না, আর যথাসম্ভব পরোপকারে সে নিজের জীবনখানা উৎসর্গ করবে।

কেননা, করোনা কারো আপন নয়, আদতে তার কোনো বাছ-বিচার নেই। শিল্পপতি থেকে শুরু করে গৃহপতিÑ করোনার ছোবলে সকলে কাহিল। এত তাড়াতাড়ি সুখেনের মরার ইচ্ছে নেই। যদিও তার মনে সুখ নেই, কারণ তার একটা চার্র্টাড বিমান এখনও কেনা হল না। চাইলেই সে এই করোনাকালে উড়াল দিয়ে শ্যামদেশ কিংবা যুক্তরাজ্যে যেতে পারছে না।

সুখেন নিয়ম মেনে চলে। সে নিত্যদিন মন দিয়ে স্বাস্থ্য-বুলেটিন শোনে। সে দশ টাকা দামের মাস্ক পরে (বুলেটিনে বলে মাক্স), যদিও এই বিষয়টা নিয়ে তার কিঞ্চিত অভিযোগ আছে। সবাই বলে মাস্ক পরো, কিন্তু কত দামের কী বৃত্তান্ত, সেসব কিছু ভেঙে বলে না। আবার কেউ কেউ মুখে নয়, থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখে। তাতে সুবিধা বেশি কিনা তাও জানে না সুখেন। তার প্রতিবেশী চালের আড়তদার নসু নাকি ন’শ টাকা দামের মাস্ক পরে। ওটা কী দিয়ে বানানো সুখেন জানে না। তারটার দাম মাত্র দশ। কালো রঙের মুখোশ। মুখোশের সামনে আবার সাদা রঙে কংকালের ছবি আঁকা। ভাগ্যিস, নিজের মাস্ক কখনও নিজে দেখা যায় না, দেখতে পেলে সুখেন হয়তো ভয়েই হার্ট-অ্যাটাক করতো (মানুষ যেমন তার নিজের দোষ দেখে না, দেখে শুধু অন্যেরটা)।

মাস্কের আবার রকমফের আছে। সার্জিক্যাল থেকে শুরু করে, বুটিদার, বাটিদার (অর্থাৎ বাটির মতো, এন-নাইনফাইভ), গেঞ্জিকাপড়, পেটিকোটের কাপড়, আবার কেউ কেউ বউয়ের বাতিল করা কাঁচুলির অংশবিশেষ দিয়ে দারুন সব জোড়া-মাস্ক বানিয়ে পরছে শোনা যায়। এর নাম শক্তির অবিনাশিতাবাদ। অর্থাৎ জিনিস কখনও ফুরায় না, শুধু মাথা খাটিয়ে রিসাইকেল করতে হয়। আগে ছিল অন্তর্বাস, আর এখন হল করোনার বাঁশ। সাবাস! সাবাস!

কেউ কেউ বলে, করোনা নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষ খুব বেশি অহংকারী হয়ে উঠেছিল, তাই একশ বছর পরে পরে এসব উদ্ভট ভাইরাসের উদ্ভব হয়। মানুষকে শুধু এটুকু মনে করিয়ে দিতে যে, হে মানুষ, প্রকৃতির হাতে তুমি পুতুল মাত্র। খুব বেশি বেড়ো না, ঝড়ে উড়ে যাবে। আদতে তাই হচ্ছে এখন করোনাঝড়ে সারা বিশ্ব এখন লণ্ডভণ্ড প্রায়।

সুখেনের বউ করোনাকে বলে ‘করোলা’। তার আবার সবজিপ্রীতি বেশি। তার ছেলে বলে ‘কলেরা’। তার রোগে ভয়। সেই কবে মহামতি শেক্সপিয়র (সেক্স নয়) বলে গেছেন, নামে কী এসে যায়! সত্যিই তাই। করোনাকে তুমি যে নামেই ডাকো না কেন, তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। তার কামড়ে বিষ আছে। শুধু সামলে থাকো নইলে অকালে পটল তুলবে, একথা হলফ করে বলা যায়।

কিছু মানুষ করোনাকে কিন্তু থোরাই কেয়ার করে। তারা বাড়ি যায় খুশিতে, ঠেলায়, ঘুরতে। আরামসে তারা যাওয়া-আসা করে। এদের জন্য সুখেনের খুব দুঃখ হয়। ওরা মানুষ নামের কলংক। মহা মদন একেকটা। নইলে এভাবে করোনাকে সঙ্গী করে কেউ গ্রামে যায়! শহুরে বাবুরা গাঁয়ে গিয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে, সারা দেশ এখন শুধু করোনাময়।

করোনার কাছে সুখেনের দুটি প্রশ্ন সে কেন এমন লিঙ্গবৈষম্য করছে! প্রতিদিনের ডাটাবেজ ঘাঁটলে দেখা যায়, করোনায় যারা মারা যাচ্ছে তাদের প্রায় আশিভাগ পুরুষ। নারীর প্রতি করোনার এই আদখেলে পক্ষপাত বা যদি বলি প্রেম, সুখেন মোটেই তা মানতে পারে না। বউয়ের প্রতি তার খুব ঈর্ষা হয় আবার মায়াও হয়। বেচারি যদি কোনোভাবে টেঁসে যেত, সুখেন তাহলে একটি নতুন নারীর মুখ দেখতে পেতো। অবশ্য সবার মুখই তো এখন মুখোশে ঢাকা, দেখতো কী করে!

করোনা একরকম ‘ভাইরাস’। কেন ভাই মিছে পুরুষের নাম মুখে আনছো! ওটা কি ‘বোনরাস’ হতে পারতো না! যত্তোসব লৈঙ্গিক চিন্তা-ভাবনা। নারীবাদীরা এসব কথা কখনও মুখে আনবে না। আদতে ওরা কোনোরকম ‘বাদী’ই নয়, ওরা আসলে বিবাদী, বিবর্ণবাদী বা স্বার্থবাদী।

সুখেনের ঘরে দুটো অবোলা প্রাণী আছে। একটার নাম ভেউ, আরেকটা মিউ। এর মধ্যে ‘ভেউ’ মানে কুকুরটা বেশ চালাক-চতুর। তার জন্য একটা স্পেশাল মুখোশ কিনে এনেছে সুখেন। কুকুরটা ওটা পরে বেশ জ্ঞানীর ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাতে খুশি হয় সুখেন। কিন্তু ওই মিউ, মানে বিড়ালটাকে নিয়ে হয়েছে যত জালা। সে কিছুতেই মুখোশ পরবে না। তাতে তার গোঁফে সুড়সুড়ি লাগে। মাস্ক পরানো মাত্রই সে হাঁচতে শুরু করে। বিড়ালের হাঁচি। সুখেনের মনে ভয় হয়, বেচারি বিড়ালটাকে আবার করোনায় ধরলো না তো! ওই যে, হাঁচি-কাশি!

সুখেন আর এখন মানুষ চিনতে পারে না। কে যে ব্যাংকলুটেরা, আর কে আমানতকারী, কে বুঝবে! ভুলভাল কাগজ দেখিয়ে ওরা সাধারণের জমানো টাকা লুটে নেয়। দিতে না চাইলে গুলি ছোড়ে, ভয় দেখায়। অথচ তারা একবারও ভাবে না, করোনা কাউকে রেয়াত করে না। ওই টাকা ওরা খেয়ে যেতে পারবে তো!

সুখেনের ভবনে দুজনের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। শুনে সুখেনের অক্কা পাবার জোগাড়। লোকটা ভীতু বটে। ফলে তার বাসভবন এখন লকডাউন অবস্থায় আছে। ফলে হল কি সুখেনের খালি বাইরে যেতে মন চায়। একবার পান আনতে, তারপর সুপুরি, তারপর আবার চুন কিংবা নুন। কিছু না কিছু অজুহাতে তার খালি বাহিরপানে মন টানে। এটাই নিয়তি, মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। আটকে দাও, সে ছুটতে চাইবে, ছেড়ে দিলে অমনি ঘরে ফিরে আসে। মানুষ তো আসলে ধার্মিক নয়, সাম্প্রদায়িক। তারা ধর্ম যতটা না বোঝে বা মানে, তারচে কে মানলো না তাই নিয়ে গবেষণা করে প্রচুর। ভিন্নমত এরা সহ্যই করতে পারে না। এরা কূপমণ্ডূক, নির্বোধ। সুখেন এসব ধর্মভীরু বা বক-ধার্মিকের দলে নয়। সে মনুষ্যত্ব বোঝে। এই করোনাকালে তার খালি মানুষের জন্য কষ্ট হয়। ভুখা-নাঙ্গা অতি সাধারণ মানুষ, যারা কিনা ধর্ম বোঝে না। কেননা, খালি পেটে ধর্ম হয় না। ওরা ধর্মান্ধ নয়।

করোনার ছোবল কবে যাবে কে জানে! সুখেনের খুব দুঃখ হয়। আহা, প্রতিদিন এত এত মানুষ মরছে। একেকজন মানুষ হারিয়ে যাওয়া মানে একটি পরিবার নির্বান্ধব হওয়া। এই যে অপূরণীয় ক্ষতি, কোনোভাবে কি তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব!

সুখেন তার চশমার কাচ মোছে, কংকালের ছবিখচিত মাস্কটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। হঠাৎ তার নিজের মৃত্যুর কথা মনে হয়। মানুষ মরে গেলে কী হয় কংকাল! সুখেন মারা গেলে কে কতটুকু কাঁদবে সে জানে না, তবে পরিবারের কথা তার খুব মনে হয়। সে বুঝতে পারে, মৃত্যুটা এখন খুব কাছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

মনোকষ্ট কমাতে টিভির সুইচ অন করে সুখেন। টিভি তো নয়, কমেডি-বক্স। টিভিতেও এখন ফেসবুক ঢুকে গেছে। সেখানে লাইভে কারো ‘ভেকসদৃশ’ চেহারা দেখা যায়, বক্তার কথা আটকে যায়, পুরোনো রেকর্ডের মতো ভেঙে ভেঙে আসে। ব্যাপক মজা পায় সুখেন। ভেবে অবাক হয়, এই দুর্দিনেও মানুষের চোপা দেখানোর কী নিদারুণ আকুতি! জীবনে সায়েন্স পড়েনি, অথচ সে করোনাভাইরাস নিয়ে জ্ঞানগর্র্ভ বক্তব্য দিচ্ছে। বৈদগ্ধ ফলাচ্ছে। আবার কিছু গর্দভ তাতে করতালি দিয়ে উৎসাহও যোগাচ্ছে।

ফেসবুক খোলে না সুখেন। রীতিমতো আতঙ্ক হয়। কতো কী যে হচ্ছে সেখানে! নাচন-কুঁদন, আচ্ছাসে পাছাপ্রদর্শন, বাঁশের ন্যায় চেরা গলায় উচ্চাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ-সঙ্গীত, আবেগে গদগদ ভঙ্গিমায় কবিতাপাঠ, করোনা নিয়ে জ্ঞানবাণী, ঢকঢক করে গরম পানি না খেলে কী হবে সেই বিষয়ে বিস্তর সতর্কবাণী কী নেই সেখানে! সাহিত্যচর্চাও চলছে দেদার। চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে মহীরূহ, স্বয়ম্ভু লেখক, স্বঘোষিত মহাকবি ও ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত সকলে সমানে সাহিত্য ঝাড়ছে। অথচ ওরা জানে না, এসব কেউ খুব একটা পড়ে না এখন। পাত্তাও দেয় না, আঙুলের ছোঁয়ায় জাস্ট স্ক্রল-ডাউন করে নিচে নেমে যায়। এই বিপদে পড়ার মতোন ধৈর্য আছে কারো! আর আছে কিছু বিজ্ঞাপন। ‘গিন্নির ভাইয়েরা’ এমন নির্বোধ যে, এটুকু বোঝে না কখন কী জিনিস বিপণন করতে হয়! এই চরম আকালেও তারা মুনাফা খোঁজে, কীভাবে ব্যাংকহিসাব খুলতে হবে তা শেখায়, শাড়ি-চুড়ি-গয়না বেচে, মুক্তো আনতে সাগর সেঁচে।

বিশ্বাব্যাপী চলছে এখন সুখের আকাল। টাকার ব্যাংক, ব্লাড ব্যাংক, শুক্রাণু ব্যাংক আছে, অথচ যদি একটু সুখের ব্যাংক থাকতো! সুখেনের এখন সুখের খুব প্রয়োজন। করোনার ভয়টা জেঁকে বসেছে ক্রমশ, আক্রান্তের সংখ্যা নাই বা বলি, মৃতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দশ থেকে কুড়ি, তারপর আঠাশ, আর এখন একলাফে চল্লিশ। সংখ্যাটা কবে শ’ ছাড়াবে তাই ভাবছে সুখেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :