জাতীয় বাজেট ২০২০-২১

প্রবৃদ্ধির হিসাবের চেয়ে করোনাকাল উত্তরণ জরুরি

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২০, ২০:০৯ | আপডেট: ০৩ জুন ২০২০, ১৮:১৮

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগ যে তাণ্ডব চালাচ্ছে  তা নজিরবিহীন। পৃথিবীর ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই সংক্রমণ ঘটেছে। মাত্র কয়েকটি অঞ্চলে হয়তো ভাইরাসটি পৌঁছেনি। কিন্তু ওই অঞ্চগুলোতে অতি অল্প কিছু মানুষ বাস করেন। ভাইরাসটি ছোঁয়াছে হওয়ায় এবং এর প্রতিষেধক না থাকায় সর্বত্র মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থগিত করতে হয় বলে আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে দেশে দেশে, বিশ্ব অর্থনীতিতে। মন্দা (recession) তো পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। যেহেতু এই মহামারি দীর্ঘায়িত হচ্ছে তাই এক বিশ্ব-মহামন্দা (depression) দরজায় কড়া নাড়ছে। অর্থাৎ মন্দা গভীর ও দীর্ঘায়িত হবে। পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

বাস্তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা হলো বেকারত্ব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে, উৎপাদনে ধস নামছে, অনানুষ্ঠানিক খাতসমূহে যাদের কাজ করার সুযোগ থাকছে তাদের মজুরি কমে যাচ্ছে। আর স্বনিয়োজিত হলে আয় ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, খুচরা বিক্রয়ে ধস নেমেছে। ফলে বাংলাদেশের মতো সব দেশে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এবং গভীরতর হচ্ছে।

বাংলাদেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে লকডাউন আরোপ করা হয় ২৬ মার্চ থেকে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা বিরাজ করায় একদিকে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং অন্যদিকে অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যায়। কাজেই ৬৬ দিন পর লকডাউন তুলে নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে ৩১ মে। অর্থনীতি আবার চালু করার প্রয়োজনীয়তা যে বিশেষভাবে দেখা দিয়েছে তাতে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয়, সাধারণত অন্যান্য দেশে যখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে নিচের দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে নামছে, তখন অর্থনীতি চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়েছে যখন উভয় সংখ্যাই বাড়ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে তা আগামী দিনগুলোতে আরও আনেক বাড়বে। আমরা উভয় সংকটের মুখোমুখি- একদিকে জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে জীবিকা নিশ্চিতকরণ।

বাংলাদেশ একসঙ্গে দুটি সংকট মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। সম্ভব হতে পারে যদি সংশ্লিষ্ট সব মানুষ কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষাসংক্রান্ত সব বিধিবিধান সতর্কতার সঙ্গে পালন করেন। তা না হলে সংক্রমণ ব্যাপকতর হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আবার লকডাউনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। আর তা হলে অর্থনীতি ও সমাজ আরও বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে। সেই জন্য আমি মনে করি, অধিক সংক্রমণ ঝুঁকিতে দেশের যে এলাকাগুলো রয়েছে, সেগুলোতে সান্ধ্য আইন জারি করে হলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আসল কথা হলো, যা প্রয়োজন তা-ই করে সংক্রমণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

এখন যেহেতু অর্থনীতি খুলে দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। প্রয়োজনে সেটা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করা জরুরি যাতে অবস্থার সেরকম অবনতি ঘটলে তা সঙ্গে সঙ্গে জানা যায় এবং প্রয়োজনে আবার দ্রুত লকডাউন বা অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে কোথাও কোথাও সান্ধ্য আইন জারি করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সব মানুষ যথাযথভাবে করোনাকালে করণীয় ও বর্জনীয় মেনে চললে, জীবন ও জীবিকা সুরক্ষায় একই সঙ্গে অগ্রগতি করা সম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করেন এবং দেশে ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে লকডাউন প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু তা কার্যকর হতে পারেনি। কেননা একদিকে মানুষ করোনাসংক্রান্ত বিধিবিধানন মেনে চলেনি, অন্যদিকে যারা বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন তারা ঢিলেঢালাভাবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে সুফল তো তেমন পাওয়া যায়নি, বরং সংক্রমণ পরিস্থিতি অবনতির দিকে যায়। আজ (৩১ মে) যখন এই লেখা তৈরি করছি তখন জানলাম এদিন সর্বোচ্চ ১১,৮৭৬ নমুনা পরীক্ষা করে সর্বোচ্চ ২,৫৪৫ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। মৃত্যুও এদিন সর্বোচ্চ ৪০ জনের।

দেখা যাচ্ছে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। যত খারাপ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তত খারাপ না হলে ভালো। তবে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। একই সাথে আশা রাখা যেতে পারে যে, অবস্থা সে রকম খারাপ হবে না।

প্রধানমন্ত্রী ১৩ এপ্রিল করোনাকালে বিধ্বস্ত অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা সুরক্ষা এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জন্য প্রণোদনা সম্বলিত যে বড় আকারের (প্রায় এক লাখ কোটি টাকা, জাতীয় উৎপাদের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ) প্যাকেজ ঘোষণা করেন, তা সময়োপযোগী ও সুচিন্তাপ্রসূত। তবে বিভিন্ন খাত ও জনগোষ্ঠী উদ্দিষ্ট সহায়তা ও প্রণোদনা সময়মতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন এখনো শুরুই হয়নি (উদাহরণ: গ্রামে ও শহরের অনানুষ্ঠানিক অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ, যেগুলোর সংখ্যা প্রায় এক কোটি এবং যেগুলোতে তিন কোটির মতো শ্রমশক্তি নিয়োজিত), যদিও দেড় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেল ঘোষণার পর। কাজেই যথাসময়ে প্যাকেজটি ঘোষণা করা সত্ত্বেও সুফল সেরকম পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবায়নে অনেক সময় উল্লেখযোগ্য ঘাটতি থাকে বলে আমাদের অগ্রগতি যতটা হওয়া সম্ভব ততটা হয়নি। কখনো কখনো বাস্তবায়কদের মধ্যে অঙ্গীকার ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতিও দেখতে পাওয়া যায়।

করোনাকাল ও করোনা-উত্তরকালে এসব সমস্যার সমাধান করার দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। অর্থাৎ আমরা এক ধরনের নতুন বাস্তবতায় অবতীর্ণ, যেখানে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অতীত থেকে জেঁকে বসা এ রকম বোঝা ঝেড়ে ফেলার এবং এই সুযোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

২০২০-২১ রাজস্ব বছরের বাজেট শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। সাধারণত যে পারিপার্শ্বিকতায় বাজেট প্রণয়ন করা হয়, এবার তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই গতানুগতিকভাবে এই বাজেট প্রণয়ন করা যাবে না। বর্তমান অস্বাভাবিক বাস্তবতাকে অবশ্যই ধারণ করে বাজেট বিন্যাস করতে হবে। বাজেটসংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে এখানে কিছু কথা বলতে চাই- যেমন: বাজেটের দর্শন, বাজেটের আকার, অর্থ সংগ্রহ, প্রবৃদ্ধি, বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং বাস্তবায়ন।

কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষ ও মানবতা সামনে চলে এসেছে। কাজেই যারা আগে নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন, তারাই করোনাকালে বেশি কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। যাদের নিজেদের অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ছিল, সেগুলো বিনষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত স্বল্প আয়ের মানুষ হারিয়েছেন তাদের আয়ের উৎস। ফলে দারিদ্র্য বাড়ছে ও গভীর হচ্ছে। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, পাশাপাশি অতিদরিদ্র মানুষ নিঃস্ব, দরিদ্র মানুষ অতিদরিদ্র এবং অদরিদ্র দরিদ্র হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, করোনাপূর্ব সময়ে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, করোনা মহামারির প্রভাবে তা বেড়ে ৩০ বা ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফলে আগে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যেখানে সাড়ে তিন কোটির মতো ছিল, এখন তা বেড়ে সাড়ে ছয় বা সাত কোটি হয়ে যাবে বলে দেখা যাচ্ছে।

আগেও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য প্রকট ছিল, যা এই মহামারির প্রভাবে অনেক গভীর হচ্ছে। এ রকম সমাজ টেকসই হয় না। সারা বিশ্বে করোনাপূর্ব সময়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে ছিল পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদ। এই বৈষম্য করোনাকালে আরও শোচনীয় হয়েছে। এখন পৃথিবীর সর্বত্র বেকারত্ব বাড়ছে ব্যাপকভাবে এবং অগণিত অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে এবং আরও হচ্ছে। ফলে অন্যায্য অস্থির বিশ্ব আরও অস্থিতিশীল হচ্ছে।

কাজেই অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের আসন্ন বাজেটের দার্শনিক ভিত্তি হওয়া উচিত মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই প্রক্রিয়ায় মানসম্পন্ন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে পিছিয়ে থাকাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের সব অধিকার অর্জনে পারঙ্গম করে তোলা অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই সুযোগে আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিধৃত গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

বাজেটের আকার কোভিড-১৯ মহামারি উদ্ভূত বাস্তবতার আলোকে নির্ধারণ করতে হবে, গতানুগতিকভাবে নয়। এখানে মূল বিবেচ্য দুটি বিষয় হলো, এর জন্য সম্পদ সমাবেশের সম্ভাব্য মাত্রা এবং বাস্তবায়ন সক্ষমতা। রাজস্ব আদায় চলতি বছরে ১৬ থেক ২০ শতাংশের মতো কম হতে পারে বলে বিভিন্ন প্রাক্কলনে দেখা যায়। আগামী বছরে রাজস্ব সংগ্রহে সমস্যা আরও বেশি হবে। বাজেট ঘাটতি বাড়ানো যায়, তবে তা পরবর্তী সময়ে সমস্যা সৃষ্টি করবে। সাধারণত জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ পরিমাণ বাজেট ঘাটতি গ্রহণযোগ্য। আমি মনে করি, আসছে বাজেটে ঘাটতি ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তবে সাশ্রয় করার কিছু সুযোগ আছে, সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের বাজেট বরাদ্দ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ খরচ করা যাবে না, যা পরবর্তী বাজেটে ব্যবহার করা; অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেয়া; এবং অপ্রয়োজনীয় এবং কম প্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় সংকোচন করা।

অবাস্তব আশাবাদ উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করতে পারে নানা টানাপোড়েন সৃষ্ট করে। আমি কোনো অংক বলতে চাই না, কেননা আমার কাছে সব তথ্য নেই। চলতি বছর বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, পরে সংশোধন করে কিছু কমানো হয়েছে। চলতি বাজেটের ঘোষিত (৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি) মূল আকারের মতো আগামী বাজেটের আকার রাখা যেতে পারে। বিগত বছরগুলোতে প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আকার বড়ানো হয়েছে। এবারের বাস্তবতা সে রকম কিছু করা সমর্থন করে না।

 

জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অনেক দেশেই এ বছর (২০১৯-২০) এবং আগামী বছর (২০২০-২১) ঋণাত্বক হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে একাধিক প্রাক্কালন দেখা যায়। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস হলো- এ বছর ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং আগামী বছর ১ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। আমার বিবেচনায়, প্রবৃদ্ধির হিসাব-নিকাশে সময় ব্যয় না করে অর্থনীতিকে, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চালু এবং চাঙ্গা করায় মনোনিবেশ করা উচিত। বাস্তবানুগ সঠিক কাজ করলে সম্মানজনক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বেশ কিছুদিন হয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার যেসব খাতে দিতে হবে তা উল্লেখ করেছেন: কোভিড-১৯ থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সব করণীয় অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাত; এই মহামারির কারণে যাদের জীবিকা বিধ্বস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে (দরিদ্র এবং এই মহামারির কারণে যারা অর্থিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেই কোটি মানুষ) তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি; এবং জাতির খাদ্য নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য কৃষি খাত (শস্য, শাক-সবজি, ফল, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু)। এই তিন খাতের সঙ্গে শিক্ষা যোগ করলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য চারটি খাত নির্ধারিত হয়ে যায়। এখন দেখতে হবে বাজেট বিন্যাসে এই খাতগুলোর অগ্রাধিকার কীভাবে প্রতিফলিত হয়।

শেষ করার আগে সাস্থ্য খাত সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই। এই খাতটি অগ্রাধিকারের একেবারেই প্রথমে থাকবে। প্রথমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, এর জন্য কী কী করতে হবে তা ইতোমধ্যে সরকার করছে। তবে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তার ফলে আমাদের সক্ষমতায় (নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো, সংক্রমিতদের যথাবিহিত ব্যবস্থা করার এবং সেই জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা; ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিইর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি) ঘাটতি রয়েছে অনেক। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অর্থায়ন লাগবে এবং গৃহীত কর্মসূচির সময়মতো কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

করোনার সময়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্বলতা সামনে এসেছে। সেই আলোকে এই খাতকে সমৃদ্ধ করা জরুরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবিকতার যে উদ্বোধন ঘটে তারই তাগিদে যুক্তরাজ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলা হয় এবং সার্বিকভাবে দেশকে কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তর করা হয়। কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় মানবতার জাগরণে আমরা বাংলাদেশে কাঙ্খিত গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে পারি। এর একটি বিশেষ অনুষঙ্গ হিসাবে সর্বজনীন মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ আসন্ন বাজেটে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।

বাস্তবায়নে আমাদের ঘাটতি থাকে সব সময়। সেজন্য সুফল যতটা পাওয়ার কথা তা থেকে কম পাওয়া যায়। বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানো এবং গাফিলতি-দুর্নীতি দমনে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। স্মর্তব্য, সরকারি নীতি হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা।

লেখক: অর্থনীতিবিদ।

(ঢাকাটাইমস/১জুন/মোআ)