বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২০, ০৮:০৬ | আপডেট: ০২ জুন ২০২০, ০৮:০৯

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

সেই কবে যে বাংলার মাটিতে নির্মল বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলাম মনে নেই!  একদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় ফিরে কেমন যেন একটি গন্ধ পাচ্ছিলাম। অপূর্ব সুন্দর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার প্রশান্তি সেদিনই শেষ।  সকালে আবিষ্কার করলাম মাছের চাষ করতে মাছের খাদ্য আনা হয়েছে।  তার গন্ধে সারারাত ঘুমোতে কষ্ট। নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকা। এরপর শুরু হলো পোল্ট্রির উৎপাত।  এরপর গার্মেন্টস।  একদিন প্রায়ত মেয়র আনিসুল হক বললেন উন্নয়ন চাইলে একটু কষ্ট নিতে হবে। এভাবে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই।

উন্নয়নের ধুলোবালিও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে নগরবাসীর। একসময় ছিল সেশনজট। এখন যানজট থেকে শুরু করে অনেক রকম জট।

একদিন আমরা উন্নত হবো, বুক ভরে ভোরের নিঃশ্বাস নেবো এই আশায় আমরা দিন গুনছি। আমাদের সেই দিনগণনা শেষ যেন হতেই চায় না। এমনি দম বন্ধ করে থাকতে থাকতে যখন আমরা হাঁপিয়ে ক্লান্ত তখন এলো চাইনিজ ভাইরাস করোনা কোভিড -১৯ রোগ নিয়ে। এবার বুকটা আরও টাইট হয়ে গেলো। মাস্ক পরে একটু একটু করে নিঃশ্বাস নেয়া। ভয়ে ভয়ে পথচলা!

এভাবেও সম্ভব হচ্ছিলো না বেঁচে থাকা। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, মস্কোর আকাশে কান্নার শব্দ ও চেপে চেপে নিঃশ্বাস নেয়া। হাজার হাজার প্রাণহানির খবরের মাঝে আম্পানের তাণ্ডবের খবর। আর যেন পারছি না!

এতসব কিছুর পরেও বেঁচে থাকবার স্বপ্ন নিয়ে দিনাতিপাত। ১৯৭১ সালে এমন দিন আমাদের জীবনে এসেছিলো। দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আবার দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে এরশাদের সামরিক আইনে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা! ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে দম বন্ধ করে থাকা। যেন সেই দম বন্ধ করে থাকার দিন শেষ হতে চায় না!

এমনি এক দুঃসময় যখন সারা বিশ্বের মানুষ পার করছে তখন মিনোপোলিশ পুলিশ দম আটকে ধরলো আমাদের মতো এক কালো মানুষের! সে আমাদের বীর পুরুষ জর্জ ফ্লয়েড।

জর্জ ফ্লয়েড কাতর স্বরে বলছে, “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।“ কিন্তু পা দিয়ে গলাটাকে চেপে রেখেছে পুলিশ! কি নির্মম দৃশ্য আমাদের দেখতে হলো! মনে হলো ওই পুলিশটার মতো করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের মানুষের কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। আমরা কেউ নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।“-এখন বিশ্ববাসীর শ্লোগান। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে- নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে টরন্টো। মানুষ মুক্তিকামী হয়ে উঠছে, কাঁপছে ওদের বুক!

এমন নির্মমতাকে ছাপিয়ে দিল লিবিয়ায় ঘটনা। ২৬ জন তাজা তরুণ নিহত হলো! এরকম নির্মমতা আমাদের আর কত দেখতে হবে?

একদিকে কোভিড-১৯ আমাদের কণ্ঠ চেপে ধরেছে! প্রায় চার লক্ষ মানুষ বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে দ্রুত চলে গেলো না ফেরার দেশে। করোনাভাইরাসের এই নির্মমতা কিভাবে বিশ্ব ভুলবে?

সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বাংলার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল পিলখানার বিদ্রোহীরা। নিমেষেই কেড়ে নিয়েছিল ৫৭ জন সামরিক অফিসারের প্রাণ! এরপর দেখেছি- নিউজল্যান্ডের মসজিদের লাইভ শুটিং, যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল শুটিং, আর কতকাল এভাবে বুকে নিঃশ্বাস চেপে থাকতে হবে?

কিছু মানুষের দায়িত্বহীনতাকে আর কত সহ্য করতে হবে? লকডাউনের নামে ছুটি, জীবিকার নামে লকডাউন শিথিল করে সুযোগ নেয়া, খরচ পুষিয়ে নেয়ার নামে বাস ভাড়া বাড়ানো! এক অধ্যাপক লিখেছেন - দেশ চালাচ্ছে কে? আমারও প্রশ্ন দেশ আসলে কে চালাচ্ছে?

৩১ ডিসেম্বর উহানে করোনাভাইরাস তাণ্ডব শুরুর পর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষ, প্রবাসী কল্যাণ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একটি পরিকল্পনা: মহামারি মোকাবেলা করা। কারও কোনো হুঁশ ছিল বলে মনে হয় না! এখনো আছে কি?

বরেণ্য লেখক জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন - আমরা দেখে বা ঠেকেও শিখি না। তিনি যথার্থই লিখেছেন। আর তাই কোনো প্রস্তুতি ছাড়া খুলে দিলাম সব কটি জানালা। জানালা খুললে ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারার কথা। কিন্তু সেটার পরিবর্তে দম বন্ধ করে থাকা।

এই দম বন্ধ করে থাকা অবস্থার থেকে বাঁচতে চাই। আর একাজে আমার ছাত্র সোনামনিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তোমরা নিজেদের পাড়ায়, পাড়ায়, ঘরে ঘরে গিয়ে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের আলাদা করতে সাহায্য করতে পারো। তাদেরকে আলাদা করতে পারলে করোনাভাইরাস ছড়াবে না বাতাসে। আমরা সকলে আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো। তোমাদের কাছে আমাদের এই ছোট্ট চাওয়া। তোমরাই পারো বদলে দিতে এই দেশ, সমাজ, তথা বিশ্বকে! তোমরা আসবে কি সব কটা জানালা খুলে দিতে? আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তোমরা যদি জেগে উঠো- আমরা আর পারছি না! "ওরে নতুন, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘাঁ মেরে তুই বাঁচা!" দুর্নীতি, লুটপাটের অমানিশা দূর করতে তোমাদের পাশে সকলে থাকবে আশা করি?

জর্জ যেন আমাকে জাগিয়ে দিলো। জেগে উঠো, প্রতিবাদ করো! তোমরা প্রতিবাদে থাকবে না? আমার সন্তানকে আমার বলতে হয়নি প্রতিবাদ করতে! সে লিখেছে - Start with those around you. If you don't fix the problems around you then trying to solve problems for others is pointless. It's just a chain reaction, your action to your community can build onwards towards the international community. বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু চাই!

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়