তুমি রবে সরবে...

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২০, ১১:০২ | আপডেট: ০২ জুন ২০২০, ১১:৫১

পাভেল ইসলাম

৭ মে অফিস যাওয়ার পর খোকন ভাই (কক্ষ নং ৩) বললেন, কামাল ভাই তো সকাল থেকে হাঁচি দিচ্ছেন, জানেন! পরে আমিও ঘটনার সত্যতা পেয়েছিলাম। হাবিব শাকিল স্যারের রুমে (কক্ষ নং ৪) বসে কথা বলছিলেন। আমি একবার তাকিয়ে নিজের রুমে (কক্ষ নং ৫) ঢুকলাম। করোনাকালীন ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী ঐ দিন আমার আর কামাল স্যারের অফিসে আসার কথা ছিলোনা! দায়বদ্ধতা থেকেই আসতে হয় আমাদের। সে ব্যাখ্যা বড় কঠিন।

যাক সে কথা! ঐদিন স্যার আমার রুমে মোট ২ বার উঁকি দিয়েছিলেন। প্রথমবার জোহর ওয়াক্তের অজু করতে যাওয়ার সময় মাথা ঢুকিয়ে বললেন, পাভেল আসছেন! 'জি স্যার' বলে উত্তর দিলাম। পরে নামাজ পড়ার সময় খেয়াল করলাম উনি একবার হাঁচি দিলেন। সেদিন ৩টার পরে উনি বাসায় চলে গেলেন। রোজার পুরোটা মাস উনি বাসায় ইফতার করতে চলে যেতেন। করোনার কারণে আমার আর স্যারের ডিউটি ছিলো শনি, রবি ও সোমবার। কিন্তু স্যার তো বাসায় বসে থাকার মানুষ নন!

এই সময়েও তিনি সহসা অফিস কামাই দিতে চাইতেন না! আমি অতিরিক্ত বার হিসেবে বৃহস্পতিবারও আসতাম পরের সপ্তাহের কাজগুলো গোছাতে। মার্চ-এপ্রিলে করোনার তীব্রতা অনুভব করে আমি তাঁকে কয়েকদিন সতর্ক করেছিলাম, 'স্যার আপনি বয়স্ক মানুষ। পরিস্থিতি ভালো মনেহচ্ছে না। আপনি কিছুদিন অন্তত বাসায় থাকুন। কোন সমস্যা হলে আমরা তো আছিই!'

স্যারের জবাব, আরে আমার কিছু হবেনা! আমরা তো সব নিয়ম-কানুন মানছিই! আল্লাহ ভরসা! ৮ মে শুক্রবার পেরিয়ে শনিবার ৯ মে আমরা দু'জন যথারীতি অফিসে হাজির। পুরো অফিস শুনশান। অফিস এ্যাসিসটেন্ট মাসুদ কয়েকদিন আগেই চলে গেছে কুমিল্লা। আমাদের দেখভালের দায়িত্ব পড়েছে আরেক এ্যাসিসটেন্ট সোহেলের উপর। সকাল ১১টায় অফিসে ঢুকতাম আমরা। স্যার সেদিন একটু আগেই এসেছিলেন।

আমি আমার রুমে চুপচাপ। স্যার তাঁর রুমে চুপচাপ বসে বসে সিনেমা দেখছেন। করোনা সময়ে এটিই ছিলো তাঁর নিয়মিত কাজ। যদিও এটা উনার নিয়মিত প্র্যাকটিস। কাজের ফাঁকে যতোটুকু অবসর, হয় উনি মুভি দেখছেন, কোন ডকুমেন্টারি, বিখ্যাত কারো ইন্টারভিউ দেখছেন, গান শুনছেন, নাহয় কিছু পড়ছেন। সেদিন উনি কোন হিন্দি মুভি দেখছিলেন। পুরো অফিস নিরব থাকায় আমি শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে জোহরের আজান হলো। কিছুক্ষণ পর আমি অজু করার জন্য রুম থেকে বের হচ্ছিলাম। আমার ঠিক পাশের রুমটায় স্যারের রুম। দেখি স্যারের রুমের দরজাটা খোলা। আমি দাঁড়ালাম ঠিক উনার দরজায়। উনি আমার দিকে তাকালেন। লক্ষ্য করলাম উনার চোখ বেশ লাল, মুখটা কেমন মলিন!
বললাম, স্যার আপনার চোখ লাল কেন?
আপনার কি খারাপ লাগছে?
জবাব দিলেন, না তো!
'কিন্তু আপনার চোখ তো লাল হয়ে আছে!'
'তাই?'
'হ্যাঁ! আপনি যে গত পরশু কাশি দিলেন, কোমরে ব্যাথা ছিলো, সেটা কি ঠিক হয়েছে!'
'হ্যাঁ, এখন ঠিক আছি আমি!'
'আপনার চোখ কিন্তু স্যার লাল হয়ে আছে। মুখটাও কেমন লাগছে!'
'না না, ঠিক আছি আমি। আচ্ছা আমি অজু করার সময় আয়নায় দেখে নিবো!'
আমি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে মনে মনে ভাবছি, স্যারের চোখ এতো লাল হয়ে আছে কেন! মুভির কোন দৃশ্য দেখে স্যার কি ইমোশনাল হয়ে গেলেন!
অজু শেষ করে রুমে এসে নামাজ পড়লাম। আর কিছুই ভাবিনি। ৩টার একটু পরই সোহেল স্যারের রুমে ঢুকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো স্যারকে এগিয়ে দেয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যার তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে গেলেন, পেছন পেছন সোহেল ছুটছে। আয়নার দেয়ালের এপাশ থেকে স্পষ্ট দেখলাম।
সেদিন রাত ১১টার পরই স্যারের সহধর্মিণী জিনাত আন্টির ফোন,
'পাভেল ভাই আপনার কামাল সাহেবের তো অনেক জ্বর! এতো রাতে আমি কি করি বলেন তো!
'কি বলেন!'
'জি। অনেক জ্বর। উনি তো কারো কথাই শোনেন না। নিজে যা বোঝেন তাই করেন! এখন কি হবে পাভেল ভাই?'
'আজ দুপুরেও আমি উনার চোখ লাল দেখেছি। উনাকে বার বার বলেছিও। উনি বিশ্বাস করেননি। একটা কথা, শুনলাম স্যার নিজের কাপড় নিজে পরিস্কার করেন!'
'আর বলবেন না, উনি কেমন শুচিবাই জানেন তো! কাজের লোকের কাপড় ধোয়া উনার পছন্দ না!'
'এটা তো ঠিক না! এই বয়সে....'
'কে শোনে কার কথা বলেন! এখন কি হবে ভাই?'
'আপনি ভাববেন না। রাতটা দেখেন। নাপা খেতে দিন। ঘুমাতে দিন উনাকে। আপনি অস্থির হলে উনিও দূর্বল হয়ে পড়বেন।'
'আপনি কি একটু দেখবেন কোন ডাক্তার পাওয়া যায় কিনা! দেখেন না একটু কথা বলে কোথাও!'
'আপনি শান্ত হোন। কিচ্ছু হবেনা। এক কাজ করুন। আপনাদের কোন ফ্যামিলি ডাক্তারের সঙ্গে একটু কথা বলুন। দেখেন কি বলে! আর যে কোন প্রয়োজনে যতো রাতই হোক কল দিবেন।'
টুকটাক আরো কিছু কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ১০ মে সকালে আবার আন্টির ফোন,
'এখন একটু ভালো আছেন কামাল সাহেব'
'বাহ! ঠিক আছে, আপনি চিন্তা করবেন না।'
আরো কয়েক মিনিট কথা হলো। সব কথা পরিস্কার মনে নেই। আমি চলে গেলাম অফিসে।
১১ মে খবর পেলাম স্যারের কাশি হচ্ছে। কুমিল্লা থেকে মাসুদ বললো, স্যার কথা বলতে বলতে অনেক কাশি শুরু হলো। পরে আর কথাই বলতে পারলো না। স্যারের অনেক কষ্ট হচ্ছে।

এর মধ্যে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমার আর খোকন ভাইয়ের ফোনে কথা হচ্ছে। আমরা একে অপরকে আপডেট রাখছিলাম। ১১ মে তেই খোকন ভাই জানালেন, চেয়ারম্যান স্যার নির্দেশ দিয়েছেন কামাল ভাইকে দ্রুত হসপিটালে ভর্তি করার যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে। খোকন ভাই, হেড অব এডমিন সুলতানা বানু, বশির ভাই (আলী বশির) যথাদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরদিন ১২ মে স্কয়ার হসপিটালে ভর্তি করালেন অনেকটা কামাল ভাইয়ের অনিচ্ছায়। উনার বিশ্বাস উনার কিছু হয়নি।

এমনি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। শ্বাসকষ্ট তীব্র হওয়ায় ১৩ মে উনাকে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হলো। ১৪ মে জানা গেলো স্যারের করোনা পজিটিভ। আমি এতোদিন বিন্দুমাত্র ভয় পাইনি স্যারের কনফিডেন্স দেখে। উনার এতোটাই কনফিডেন্স যে, ভূমিকম্প হলে আমাদের অফিসটা কেমন দুলতো! সবাই পড়িমরি করে দৌড়াতো! কামাল স্যার রুম থেকে বেরিয়ে আমার দরজার সামনে এসে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতেন। একদিন বললাম,
'স্যার সবাই নামছে। আপনি নামবেন না!'
'আরে কি আর হবে! নামার সময় পাবেন? দাঁড়িয়ে থাকেন!'
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সগতোক্তি 'তাই তো!'
কিন্তু করোনা পজিটিভ হওয়ার খবরে আমার বুকটা এবার কেঁপে উঠলো। কাউকে বুঝতে দিলাম না। পরবর্তী সাতদিন আমাকে আর খোকন ভাইকে অফিস যেতে বারণ করা হলো। ঐ দিকে ঈদ আসি আসি! শিডিউল চূড়ান্ত করতেই হবে! সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছেন। লুকিয়ে চলে গেলাম অফিসে। খোকন ভাই শুনে রাগ করলেন। বুঝিয়ে বললাম তাকে।
এদিকে দিন যায় না আর। মনে মনে শুধু ভাবি,
স্যার কি কথা বলতে পারছেন!
উনার কি অফিসের জন্য খারাপ লাগছে!
আমাদের তো অনেক কাজ! ঈদ সামনে!
স্যারের কি কিছু বলার ছিলো আমাকে!
উনাকে তো আমার ভীষণ প্রয়োজন!
কি করবো, যাবো একবার হসপিটালে!
এসব ভাবতে ভাবতে বেশ কয়েক দিন চলে গেলো! স্যারকে প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়েছে। আশার আলো। স্যারকে হিমোগ্লোবিন দেয়া হয়েছে। আশার আলো। স্যারকে প্লেটলেট দেয়া হয়েছে। আশার আলো!
ঈদ চলে আসছে। আশার আলো।
স্যার চলে আসবে। আশার আলো।
ঈদ প্রায় চলে গেলো! স্যার কই!
২৯ মে স্যার ভালো নেই!
৩০ মে স্যার এখন ভালো!

৩১ মে স্যারের অবস্থা খারাপ! দুপুর ২টার কিছু পরে জানা গেলো, আমাদের কামাল স্যার আর নেই! জোহরের নামাজ পড়ে স্যারের জন্য ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম। আসরের পর তাঁর শেষকৃত্য হয়ে গেলো! কবরে স্যারের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে একমুঠো মাটি দিয়ে সালাম করলাম শেষবারের মতো।
১ জুন সারাদিন অফিস করলাম। মাগরীবের নামাজ পরে স্যারের রুমের তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। সব ঠিক সেভাবেই আছে। আমার স্যারই শুধু নেই... (চলবে)

লেখক: গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ঢাকাটাইমস/২জুন/এসকেএস