রেলসেবা উন্নয়নে পদক্ষেপ

মাহবুব কবির মিলন
 | প্রকাশিত : ০২ জুন ২০২০, ১১:১৩

রেলসেবা উন্নয়নে যেগুলো নিয়ে কাজ করব ইনশাআল্লাহ। এই প্রস্তাবগুলো মাননীয় রেল মন্ত্রী মহোদয় এবং সচিব স্যারকে দিয়েছি। ভাল করে পড়ে দেখুন। আর বাকি কিছু থাকলে জানাতে পারেন। এরমধ্যে একটি বাদ পড়েছে, তা হল কমলাপুর স্টেশন এক্সটেনশন। ৩য়, ৪র্থ লাইন চালু হলে কমলাপুরে প্ল্যাটফর্ম বাড়াতেই হবে।

১। রেলের টিকিট কালোবাজারি রোধে অনবোর্ড, অর্থাৎ ট্রেনে যাত্রীর পরিচয় নিশ্চিতকল্পে যাত্রীকে অবশ্যই ন্যাশনাল আইডি কার্ড সাথে রাখতে হবে। টিকিট চেকার টিকিটে যাত্রীর নামের সাথে এনআইডি কার্ডের তথ্য মিলিয়ে যাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত হবেন। ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত, যাদের এনআইডি কার্ড নেই, তাদেরকে ভ্রমণের সময় জন্ম সনদ সাথে রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষ টিকিটের নামের সাথে জন্ম সনদের তথ্য মিলিয়ে নেবেন। পারিবারিক ট্যুরে একের অধিক যাত্রী থাকলে, তাঁদের যে কোন একজনের নামে টিকেট কাটলেই হবে এবং তাঁকে অবশ্যই এনআইডি সাথে রাখতে হবে।

যেহেতু রেল আইনের ১১৪ ধারা (রেল আইন, ১৮৯০) মোতাবেক টিকিটের হস্তান্তরযোগ্যতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কাজেই এই ধারা কার্যকর করার লক্ষ্যে, অনবোর্ড যাত্রিকে অবশ্যই মূল এনআইডি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মূল জন্ম সনদ প্রদর্শন করতে হবে। একজনের নামে ক্রয়কৃত টিকিট অন্য কেউ ব্যবহার করলে অর্থাৎ হস্তান্তরকৃত টিকিট পাওয়া গেলে সে যাত্রী/যাত্রীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এই প্রক্রিয়া কঠিনভাবে বাস্তবায়ন করা হলে টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করা সম্ভব হবে।

এ জন্য রেলকে নির্বাচন কমিশন এনআইডি সার্ভারের সাথে অফিসিয়ালি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। যাত্রীকে টিকিট ক্রয়ের আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন করার সময় এনআইডি সার্ভারের সাথে যাত্রীর দেয়া এনআইডি নাম্বার মিলে গেলেই তবে সে একটি আইডেন্টিক্যাল পিন নাম্বার পাবে, যা পরবর্তীতে টিকিট ক্রয়ের সময় ব্যবহৃত হবে। সেক্ষেত্রে অনলাইন টিকিট ৭৫% করা এবং একক ব্যক্তির ভ্রমণের সাপ্তাহিক কোটা তুলে দেয়া যেতে পারে।

২। ঘরে কিংবা অফিসে বসে অনলাইনে করা টিকিট ফেরত অর্থাৎ রিফান্ডের ক্ষেত্রে যাত্রীকে যেতে হয় স্টেশনের কাউন্টারে। দেশের সরকারি এবং বেসরকারি বিমান এবং বাস কোম্পানিগুলো অনেক আগে থেকেই অনলাইনে করা টিকিট রিফান্ডের ক্ষেত্রে অনলাইনেই ব্যবস্থা রেখেছে, কাউন্টারে যেতে হয় না। ট্রেন যাত্রীদের কাছে অনলাইনে করা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে রিফান্ড করা এক বড় বিড়ম্বনার বিষয়। কাজেই রেলের ক্ষেত্রেও সে ব্যবস্থা গ্রহন অতি সহজ একটি বিষয়।

৩। প্রারম্ভিক স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোর যাত্রীরা সহজে বুঝতে পারেন না, কোন কোচ কোন জায়গায় দাঁড়াবে। অতি অল্প সময়ে কোচের সঠিক অবস্থান বুঝতে না পারার কারণে যাত্রীদের, বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের ট্রেনে উঠতে গিয়ে মারাত্মক বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ডিজিটাল ডিসপ্লে ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। যাতে ট্রেন এক স্টেশন আগে থাকতেই পরের স্টেশনের যাত্রীরা উপরে ঝুলানো ডিজিটাল ডিসপ্লে দেখে নিশ্চিত হতে পারেন, তাঁদের নির্ধারিত কোচের অবস্থান।

৪। যাত্রী চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায়, তাঁদের সুবিধার কথা চিন্তা করে রেল স্টেশনের বাইরে ঢাকা শহরে বিভিন্ন স্থানে টিকিট কাউন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রথম ফেজে সচিবালয় বা রেল্ভবন সহ মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ি এলাকায় সুবিধাজনক প্রশস্ত এলাকায় টিকিট কাউন্টার স্থাপন করতে হবে।

৫। ট্রেন লেট করে ছাড়ার একটি বড় কারণ, ট্রেনটি স্টেশনে এসে আবার ফেরত যাবার আগে দীর্ঘ সময় ধরে রেক ম্যানুয়াল ওয়াশ করতে হয়। দ্রুততম সময়ে ওয়াশ করতে হলে কমলাপুরে একটি অটোমেটিক ওয়াশ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সব বড় স্টেশনগুলোতে অটোমেটিক ওয়াশিং প্ল্যান্ট রয়েছে।

৬। ট্রেন ছাড়তে কমপক্ষে এক ঘন্টা বিলম্ব হলে, ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পূর্বে মোবাইলে এসএমএস বা এপস এর মাধ্যমে যাত্রীকে জানিয়ে দিতে হবে।

৭। ট্রেনে ক্যাটারিং সার্ভিস এবং খাবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে খাবার গাড়িতে উন্নতমানের গ্যাস সিলিন্ডার সহ চুলা এবং ওভেন ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে। অনেক বছর আগে ঢাকা সিলেট রুটে কালনি এক্সপ্রেসের খাবার গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর সব ট্রেনের খাবার গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, অথচ গরম এবং ফ্রেশ খাবার সরবরাহে চুলা এবং ওভেন ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই।

৮। অনবোর্ড অর্থাৎ ট্রেনে বসে কোন বিষয়ে যাত্রীদের অভিযোগ করতে হলে সেই পুরানো মান্ধাতা আমলের সিস্টেমে গার্ডের কাছ থেকে অভিযোগ বই নিয়ে আসতে হয়। সেটাও আর এক বড় বিড়ম্বনা। অভিযোগ বই এত পুরাতন যে, কলম ধরলেই কাগজ ছিঁড়ে যায়। এই ডিজিটাল যুগে ট্রেনে বসে এপস এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৯। টিকিট ক্যানসেল অর্থাৎ ফেরত দেয়া টিকিটের কর্তন ফি কমাতে হবে। পরীক্ষামূলকভাবে কমলাপুর স্টেশনে যাত্রীর লাগেজ বহনে ট্রলির ব্যবস্থা করতে হবে।

১০। কমলাপুর, বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে অবৈধ বা বিনা টিকিটধারী ব্যক্তির প্রবেশরোধে সমগ্র স্টেশন ফেন্সিং বা দেয়াল দিয়ে ঘিরে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। চট্টগ্রাম স্টেশনের ৬ এবং ৭ নং প্ল্যাটফর্মে ছাদ বা শেড দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষায় খোলা আকাশের নিচে যাত্রীরা এদুটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনে উঠতে গিয়ে কাকভেজা হয়ে যায়, যা অত্যন্ত অমানবিক।

১১। কমলাপুর, বিমানবন্দর সহ বড়বড় স্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্ম উঁচু করতে হবে। প্ল্যাটফর্ম অনেক নিচু হওয়ায় বিশেষ করে ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে যাত্রীদের মারাত্মক দুর্ভোগের স্বীকার হতে হয়।

১২। ট্রেনের দুর্ঘটনা রোধে, বিশেষ করে ফ্রন্ট কলিশন কিংবা রেড সিগন্যাল অমান্য করা রোধে প্রতিটি লোকোতে ডিজিটাল সেইফটি ডিভাইস স্থাপন এবং তেল চুরি রোধে প্রতিটি লোকোর ফুয়েল ট্যাংকে জিপিএস ফুয়েল ট্র্যাকার স্থাপন করতে হবে।

১৩। যেগুলো ট্রেন ঢাকা কমলাপুরে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা এসে বসে থাকে, যেমন ঢাকা এক্সপ্রেস নোয়াখালি থেকে ভোরে এসে সারাদিন প্রায় ১২ ঘন্টার উপরে অলসভাবে পড়ে থাকে, সেই ট্রেন দিয়ে মাঝে ঢাকা হতে ভৈরব বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত শাটল সার্ভিস চালানো যায়। এই রুটে যাত্রী চাপ অত্যন্ত বেশি।

১৪। আন্তঃনগর ট্রেনের (ইন্টারসিটি) সংজ্ঞা আরও স্পেসিফিক বা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে ইন্টারসিটি ট্রেনের অলাভজনক স্টপেজ দেয়া স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।

১৫। ট্রেনের চালক এবং গার্ডের মধ্যে জরুরি যোগাযোগের প্রয়োজনে ওয়াকিটকি সেটের ব্যবস্থা সহ চালকের সাথে কন্ট্রোল্রুম এবং পরবর্তী স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের সাথে জরুরি যোগাযোগের মোবাইল সেট সরবরাহ করা প্রয়োজন।

১৬। রেলে বৈধ যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে হলে ইন্টারসিটি ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকিট ইস্যু বন্ধ করতে হবে। রেলের আইনে স্ট্যান্ডিং টিকেট দেয়ার বৈধতা নেই। স্ট্যান্ডিং টিকিট দেয়া হয় শুধুমাত্র শোভন শ্রেণির জন্য, কিন্তু যাত্রীরা প্রায় সবাই এসি কোচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এসি কোচগুলোতে স্ট্যান্ডিং যাত্রী এতবেশি ভিড় করে যে, টিকিটধারী বৈধ যাত্রীরা টয়লেটে পর্যন্ত যেতে পারে না। এরা সিটের পাশে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে, সিটের মহিলা যাত্রীদের মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।

অথবা নতুন আনা কয়েকটি লাল সবুজ শোভন কোচকে স্ট্যান্ডিং কোচে রূপান্তর করে নিতে হবে আমাদের কারখানায়।

১৭। সময়মত ট্রেন ছাড়া এবং পৌঁছানোর উপর নির্ভর করে রেল কতটা যাত্রিবান্ধব বা সেবা দিতে পারদর্শী। কাজেই দেরিতে ছাড়া এবং দেরিতে পৌঁছানোর কারণ নিয়মিত অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সহ স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে।

১৮। রেলের জনবল অবকাঠামো পূনর্বিন্যাস করে রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট (R & D) উইং ও আইটি (Information Technology) সেল গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জনগণের চাহিদা ও সেবার উন্নয়নে রেলের চালিকা শক্তি হচ্ছে রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট (R & D)। অত্যাধুনিক টিকিটিং সিস্টেম প্রবর্তনে থার্ড পার্টির উপর নির্ভরশীল না হয়ে রেলের নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করবে আইটি (Information Technology) সেল।

১৯। ঢাকা চট্টগ্রাম সবচেয়ে ব্যস্ততম রুট বিধায় রাতের বেলা ননস্টপ একটি নতুন ট্রেন চালু সহ প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে একটি করে ননস্টপ ট্রেন চালু করা অত্যন্ত জরুরি। ঢাকা চট্টগ্রাম চলাচল রত সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের চাইনিজ সাদা কোচ বহু পুরাতন (১৯৯৮ সালে চালু) হয়ে গেছে বিধায় এই রেক পরিবর্তন করে নতুন ইন্দোনেশিয়ান লাল সবুজ কোচ দেয়া প্রয়োজন।

লেখক: অতিরিক্ত সচিব, রেলওয়ে মন্ত্রণালয়

ঢাকাটাইমস/২জুন/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :