একজন শিক্ষক রাশেদা রওনক খান

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২০, ১৭:৩৬

মো. শাহিন রেজা

রাশেদা রওনক খান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ তম (নৃবিজ্ঞান) ব্যাচের ছাত্রী। থাকতেন জাহানারা ইমাম হলে। হলের জুনিয়রদের যেমন স্নেহ করতেন তেমনি সিনিয়রদের প্রতি ছিল অগাধ সম্মান। ফলে সহজেই  সবার প্রিয় ও আস্থা ভাজন হয়ে উঠেছিলেন অল্প সময়ে। নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিটা পরিক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি।  এছাড়াও ক্লাসমেটদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিভাগের বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন ও অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড তাঁকে বিভাগের শিক্ষক,শিক্ষার্থীদের মাঝে স্নেহের ও সম্মানের পাত্রে পরিণত করে।

 তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। তিন ভাই- বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোন জাবির ২৩ ব্যাচের ছাত্রী। বর্তামানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।  ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাশ করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। আর রওনক ম্যাম ২০০৬ সালে জাবিতে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। বেশ কয়েক বছর জাবিতে পড়িয়ে পরবর্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বর্তমানে ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।

প্রায় দেড় বছর আগে অনলাইন পত্রিকা বাংলাট্রিবিউনে তাঁর 'প্রগতিশীল আমরা বনাম ওরা' শিরোনামে একটি লেখা পড়ি। তাঁর লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ উদ্যোগে ম্যামের সাথে দেখা করি। আমি তখনও জানতাম না ম্যাম জাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিলেন।

পরিচয়ের পর থেকেই ম্যাম আমাকে অত্যান্ত স্নেহ করা শুরু করেন। শুধু আমাকেই না তাঁর সব শিক্ষার্থীর প্রতি রয়েছে অত্যান্ত স্নেহ, মমতা ও দোয়া। মাঝে মাঝে আমি ম্যামের লেখা ফেসবুকে শেয়ার করি যাতে মানুষ সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ লেখা পড়তে পারে। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তাঁর লেখায় তিনি দেশপ্রেম, মানবিকতা, উদারতা ও সত্যের বাণী ছড়িয়ে দেন সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে। একবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। তখন আমি জাবির হলে থাকি। রাত্রে ৩৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর ফোন পেলাম। তিনি রওনক ম্যাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। কথা শেষে জানালেন ম্যাম তার প্রিয় শিক্ষক কিন্তু ৭/৮ বছর ম্যামের সাথে দেখা হয়নি। এখনও তার মনে পড়ে জাবিতে ম্যামের সাথে কাটানো সুখের স্মৃতিগুলো। এমনি ভাবে তাঁর অসংখ্য শিক্ষার্থী খবরাখবর নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। ফলে বোঝায় যাচ্ছে কতটা শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষক ছিলেন তিনি।

বেশ কয়েক মাস ধরে করোনা সার পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল যেন শেষই হচ্ছে না। ম্যাম বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থল ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অবস্থান করছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারের বিবেচনায় সবার উপরে যুক্তরাজ্য। ২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে যার মধে ৩৭ হাজারের ও বেশি মানুষ মারা গেছে। এমন একটা অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশে থেকেও তিনি দেশ ও তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভুলে যাননি।

 করোনার সংকট মোকাবিলায় তিনি পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার বার সচেতনতা মূলক লেখা লিখে যাচ্ছেন। আহ্বান জানাচ্ছেন বিপদগ্রস্থ মানুষের পাঁশে দাঁড়াতে। সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মানবিকতার পরিচয় দিতে। এছাড়াও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, হাসপাতাল গুলোতে যথাযথ চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থাসহ জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি দিকনির্দেশনা মূলক লেখা লিখছেন।

সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার তিন দিন পর আমি বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে আসার পর একটু অসুস্থতা বোধ করছিলাম। ম্যাম জানার সাথে সাথে তাঁর ডাক্তার ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। নিজের পিএইচডি, সংসার, সন্তান নিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্র/ ছাত্রীদের কথা ভুলে যাননি। শিক্ষার্থীদের সাথে তিনি সবসময় যোগাযোগ রাখছেন, করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন যাতে তারা মনোবল না হারায়। হতাশা যেন তাদের মনে বাসা না বাঁধতে পারে। কারণ করোনার কোনো টিকা / ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মনোবল দৃঢ় রাখা এখন অত্যান্ত জরুরি।

গতকাল আবার ও ম্যামের সাথে কথা হলো। আমি সুস্থ আছি কিনা প্রথমেই জানতে চাইলেন। এর পর কি ভাবে পরিবার চলছে, কোনো সমস্যায় আছে কিনা জানার সাথে সাথে এটাও বলে রাখলেন যে কোনো প্রয়োজনে আমি যেন তাঁকে জানাই। গত বছর আমি জন্ডিসে আক্রান্ত হই। এমনই ভাবে বিদেশ থেকে তিনি আমাকে রক্তের বিভিন্ন টেস্ট ডাক্তারকে দেখিয়ে পরামর্শের নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি যোগাযোগ রাখার পরও চ্যানেল আই- এর এক সাংবাদিক ভাইকে বলে রেখেছিলেন সবসময় আমার ভালো- মন্দ খবর রাখতে।

একবার ভাবেন তো নিজেই মৃত্যুর নগরীতে বসবাস করে অন্যদের কথা ভাবা কতটা সম্ভব? কতটা মানবিক, উদার, দেশপ্রেম, শিক্ষার্থীদের উপর মমতাবোধ থাকলে একজন শিক্ষক এমন চরিত্রের হতে পারে?

রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান তিনি। তাইতো সব শিক্ষার্থীকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভাবেন। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরাও তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা শিক্ষক এমন মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের মনের কোঠায় যায়গা করে নিবে।

লেখকঃ মো. শাহিন রেজা, শিক্ষক ও নাগরিক সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/২জুন/এসকেএস