বয়ঃসন্ধিকালীন ডিপ্রেশন ও কিছু কথা

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২০, ১৭:৫৮

রবিউন নাহার তমা

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা বর্তমান বিশ্বের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা ।উন্নত বিশ্বে এর মাত্রা ব্যাপক থাকলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর মাত্রা নেহায়েত কম নয়।বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে এর বিস্তার। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে বর্তমানে বয়সন্ধিকালীন সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হল ডিপ্রেশনে ভোগা।

পারিবারিক সমস্যা,পড়াশুনার চাপ,পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়া,রিলেশনশীপ জনিত সমস্যা,বুলিং এর শিকার হওয়া,প্রায়োরিটি বা মনযোগ আকর্ষণে ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা সৃষ্টি হতে। ছেলেদের ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি তুলনামুলক বেশি এবং তারা সাধারণত বহির্মুখী ব্যক্তিত্ত্বের হওয়ায় তাদের ডিপ্রেশনে ভোগার মাত্রা এবং সম্ভাবনা দুটোই কম। সে তুলনায় মূলত অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ত্বের কারণে মেয়েরা ডিপ্রেশনে বেশি ভোগে। বিভিন্ন জরিপ এবং পত্র-পত্রিকার সুত্রানুযায়ী বিষণ্ণতার হার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রায় তিনগুন বেশি।

বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরিদের ডিপ্রেশন নিয়ে কথা বলতে গেলে এখন পর্যন্ত পারিবারিক কারনই প্রধান হিসেবে বিবেচিত হবে। অভিভাভকদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন,রাগারাগি,কিশোর-কিশোরীদের প্রতি অমূলক সন্দেহ পোষণ , অতিরিক্ত পড়াশুনার চাপ দেয়া এসব কারনেই মূলত ডিপ্রেশনের সূত্রপাত হয়।তারপর ধীরে ধীরে তা বেড়ে চলে ।তখন একটু আঘাত দিয়ে কথা বললেই ছেলেমেয়েদের মনে তা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।

তুলনামুলক অসচেতন কিংবা শিক্ষিত পরিবারের অভিভাবকদেরও প্রায়ই বলতে শোনা যায় নিজ সন্তানকে বলছেন-“ পড়াশুনা না করলে রিকশা চালিয়ে খাবি অথবা পড়াশুনা না করলে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো” !খুব সহজেই বলা হয়ে যায়। কিন্ত যে শুনছে তার কেমন লাগে সেটা শুধু সেই বলতে পারে। বিশেষ করে এই –“ রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো”- এ জাতীয় ব্যাপারটাতে অনেক কিশোরী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্য বেশী হলে সেটা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়। প্রতিবছর একেকটা পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ পায় আর কয়েকজন করে শিক্ষার্থীর (বিশেষত কিশোরীদের) আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় আসে। যা খুবই দুঃখজনক। অথচ একটা পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া মানে যে জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয় তা হয়তো জীবদ্দশায় ওরা বুঝতেই পারেনি!অথবা কেউ ওদের বোঝায়ওনি। 

প্রযুক্তির অতিমাত্রায় ব্যবহার ডিপ্রেশন সৃষ্টির অন্যতম একটি কারন।আমার দেখামতে এবং বিশ্বাসে এ যুগের কিশোর-কিশোরীরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান,সচেতন,সৃজনশীল ও মেধাবী ।তবে তাদের সৃজনশীলতা ও মেধার বিকাশে একটি বড় বাঁধা হতে পারে প্রযুক্তির অপব্যবহার। বর্তমান যুগ টেকনোলজির যুগ। সুতরাং টেকনোলজি তারা কেন ব্যবহার করবে না? অবশ্যই করবে। তবে টেকনোলজির হুজুগে পড়া চলবে না !টেকনোলজির ফাঁদে পা দিয়ে সন্তান যেন বখে না যায় সেজন্য অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

টেকনোলজির ব্যবহার সম্পর্কেও ভালোভাবে জানতে হবে যেন চাইলেই আমার অনলাইনে ক্লাস আছে, অ্যাসাইনমেন্ট আছে এসব বলে ছেলেমেয়েরা মোবাইল বা ল্যাপটপের কোনরকম অপব্যবহার না করতে পারে।ইন্টারনেট সিকিউরিটি অথবা প্যারেন্টাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা আমাদের দেশে অপ্রতুল। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়াটা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছে।

বর্তমানে ডিপ্রেশনের অন্যতম একটা কারণ হল রিলেশনশীপ। এটা হতে পারে ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক। এক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদেরও কিছুটা সচেতন থাকা উচিৎ।সঙ্গী বা বন্ধু যেটাই নির্বাচন করা হোক না কেন এক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে। ঘনিষ্ঠ মানুষদের জীবনযাত্রা সচেতন বা অবচেতন দুইভাবেই আমাদের নিজ নিজ জীবনযাত্রায় স্বভাবতই প্রভাব ফেলে।

উদাহরণস্বরূপ- আমরা যদি এমন বন্ধুদের সাথে মিশি যারা খুব ভ্রমণ প্রিয়,দেখা যাবে তাদের কাছে গল্প শুনতে শুনতে অথবা ছবি দেখতে দেখতে আমরাও ভ্রমণ পিয়াসী হয়ে গেছি। অথবা আমার একদল বন্ধু জাংক ফুড খেতে খুব পছন্দ করে,ক্রমাগত তাদের সাথে মিশতে মিশতে প্রতিদিনেরডিম-দুধ খাওয়ার অভ্যাস বদলে সেখানে নিজের অজান্তেই অস্বাস্থ্যকর খাবারের বড়সর একটা তালিকা ঢুকে গেছে !

এবারে আসি ফুড হ্যাবিট এর কথায় ।জাঙ্কফুড-যার কথা না বললেই নয়।গত এক দশকে বাংলাদেশীদের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।বিশ্ব যেখানে অর্গানিক ফুড এর ব্যপারে মনযোগী কিংবা দিন দিন যেখানে ভেজেটারিয়ানদের সংখ্যা বাড়ছে সেখানে আমাদের দেশের অলিতে গলিতে রেস্টুরেন্ট কিংবা ফাস্টফুডশপগুলোতে  উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করে আমরা জাংকফুডের ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে গেছি। অথচ অতিমাত্রায় ফ্যাট-কার্বনেট সমৃদ্ধ এই খাবারগুলো যে শুধু শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা নয়,বরং এগুলো স্ট্রেস-ডিপ্রেশন এগুলোর মাত্রাও বৃদ্ধি করে!

হা্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মেডিসিনের ইন্সট্রাক্টর এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন Mind-Body  Medicine বিশেষজ্ঞ

ডঃ এভা সেলাব এর মতে- রেড মিট,উচ্চ মাত্রার ক্যালরি সম্পন্ন ডেইরি প্রোডাক্ট,বাটার ইত্যাদি ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বৃদ্ধিকরে।

তাছাড়া ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর সুত্র অনুযায়ী  যুক্তরাজ্য , স্পেন এবং অস্ট্রেলিয়ার “Diet & Depression “ সম্পর্কিত একচল্লিশটি গবেষনায় জাংক ফুড যে ডিপ্রেশনের মাত্রা বৃদ্ধি করে তার প্রমাণ মিলেছে ( জাকার্তা পোস্ট, ১লা অক্টোবর,২০১৮)

বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজতে গেলে গতানুগতিকতার বাইরেও দুয়েকটা বিষয় চলে আসে ।ঢাকার প্রথম সারির একটি কলেজের এইচ,এস,সি দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানালেন-“ ডিপ্রেশন এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। অনেকেই এখন তাই একটু “saddist” or  ‘sad vibes’ নিয়ে থাকতে পছন্দ করে ।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ডিপ্রেশনের তেমন কোন কারণও থাকে না।যেমন-একজন পারিবারিক কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছে তা দেখে তার কাছের বন্ধুটিও ডিপ্রেশনে চলে গেছে!

বয়ঃসন্ধি কালীন হতাশা কিন্ত বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে । আমরা অনেকেই সেটা অনুভব করতে পারি না কিংবা অনেক ক্ষেত্রে জেনারেশন গ্যাপ জনিত কারনে ধরতেও পারিনা । তবে আশার কথা হল বয়ঃসন্ধিতে যারা ডিপ্রেশনে ভুগছে তাদের মধ্যে শতকরা ৫ থেকে ৭ শতাংশ severe stage এ আছে । এবং ৭০ শতাংশের সমস্যাই mild stage এর ।অর্থাৎ একটু যত্ন নিলেই এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া যাবে ।

তবে সামান্য সমস্যা দেখে “ব্যপার না, ঠিক হয়ে যাবে বয়স বাড়লে-এই ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকা যাবে না । বরং শুরুতেই ডিপ্রেশনকে উপড়ে ফেলতে হবে।কোনরকম ডালপালা মেলতে দেয়া যাবে না । কারণ-depressin বা বিষণ্ণতা একটি  দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।আমি একজন মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থীর কথা শুনলাম,যে কিনা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। পরে জানতে পারলাম সে নাকি ক্লাস সিক্স থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছে!সুতরাং বিষণ্ণতাকে হালকাভাবে নেবার সুযোগ নেই।

 বয়সন্ধিকালীন বিষণ্ণতা কিংবা যে কোন ধরণের মানসিক সমস্যা কাটাতে একেকজন অভিজ্ঞ শিক্ষক একজন মনোবিদের ভূমিকা রাখতে পারেন।আমার প্রায় সাত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে এটা দেখেছি যে,শিক্ষক–শিক্ষার্থীর interaction ভালো হলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষকের কাছে এমন অনেক কিছু শেয়ার করে যেটা তাদের বাবা মায়ের কাছেও করতে পারে না কিংবা করে না।এক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকও শিক্ষককে অনেক ভরসা করেন ।

নামকরা স্কুল কলেজগুলোতে হেলথ চেকাপের জন্য ডাক্তার আছেন।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে মেডিকেল সেন্টার । অথচ প্রাপ্ত তথ্যমতে  দেশের এক দুইটি বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই নেই কোন মনোবিদ কিংবা কাউন্সেলর, যেখানে শিক্ষার্থীদের বেশ বড় একটা অংশ ডিপ্রেশনে ভোগে আর সেখানে স্কুল কলেজতো দূরেই থাক ! তবে এ ব্যাপারে আশার বানী শুনিয়েছেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ।

জানুয়ারি মাসে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন করে,পর্যায়ক্রমে দুইজন মনোবিদ নিয়োগের কথা জানান(সুত্র:-১৬,জানুয়ারি,বাংলা ট্রিবিউন)। গত ২৪ নভেম্বর ২০১৯ সালে এডভোকেট জনাব ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়ার সুপ্রিমকোর্টে এক আর্জির প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকের ব্যবহার,আত্মহতার প্রবণতা,যৌন নিপীড়ন এর স্বীকার,মুল্যবোধের অবক্ষয়,বেপরোয়া জীবনযাপন এবং শিক্ষা-গবেষণায় চরম মাত্রায় অনাসক্তির কারণবশত তিনি সুপ্রিমকোর্টে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ নিয়োগের আর্জি পেশ করেন। এ অবস্থায় যদি সত্যিই দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় তবে নিঃসন্দেহে তা হবে অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি উদ্যোগ।

ডিপ্রেশন কাটানোর সবচেয়ে বড় সহায়ক হল পরিবার।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকার কথা দেশজুড়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তারমানে কিশোর-কিশোরীদের স্কুল-কলেজ আর টিচারের বাসায় পড়তে যাওয়ার দিনব্যাপী ব্যস্ততা এখন নেই। ওরা আছে আমার আপনার একেবারে কাছে,পরিবারের গণ্ডিতেই। থাকবে আরও বেশ কিছুদিন। সুতরাং এটাই সুযোগ ওদের মনের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার।

ওদের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে ওঠার। একজন পঁচিশোর্ধব বা ত্রিশোর্ধব মানুষের মনের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য আপনাকে দীর্ঘদিন তাকে সঙ্গ দিতে হবে,তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, তারপর হয়তো সে আপনাকে তার ডিপ্রেশনের কথাগুলো শেয়ার করবে । সেই তুলনায় কিন্তু এই কিশোর-কিশোরীদের মন জয় করা অনেক সহজ!একটু বাড়তি যত্ন,মনযোগ,আন্তরিকতা আর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে ওরা হড়বড়িয়ে মনের সব কথা আপনাকে খুলে বলবে। এই বন্ধের সময়টাতে তাই ওদের অতিরিক্ত পড়াশুনার চাপ দেয়া কিংবা বকাঝকা করা থেকে বিরত থাকুন।

ওদের সাথে সুন্দর সময় কাটান। ভালোলাগা, খারাপ লাগা, কিংবা অভাব-অভিযোগের কথা মন দিয়ে শুনুন। কোন হতাশা থাকলে তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন। ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝতে ওদের সর্বাত্মক সহায়তা করুন।তাহলেই ওরা বেড়ে উঠবে সুন্দরভাবে আর আমাদের পরিবার,সমাজ ও দেশ পাবে আলোকিত মানুষ।

লেখক: শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/৩জুন/এসকেএস