মেয়েকে কোথাও পাঠালে প্রতিনিয়ত খবর নিন

এস এম শামীম
 | প্রকাশিত : ০৪ জুন ২০২০, ১৫:৫৪

করোনাকালীন একটি ক্রাইম শেয়ার করি। হয়তো কিছু শেখা যাবে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে শাহবাগ থানায় ঢুকলাম। ওসির রুমে বসে আছি। একটি ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ে তার আপন বড় ভাইসহ দেখা করতে চায় আমার সাথে।

ভেতরে আসার পর মেয়েটি শুধু কান্নাকাটি করলো প্রায় ১০ মিনিট। সে কিছুই বলতে পারছে না অধিক কান্নাকাটির জন্য। তাকে একটু স্বাভাবিক হয়ে কথা বলার অনুরোধ করলাম।

এবার সে বলা শুরু করলো ফুপিয়ে কাঁদতে কাদতে। পুরাটা সময়ই সে কেঁদেছে যতক্ষণ কথা বলেছে। এসেছিলো খালাতো বোনের বাসায় নিজের চিকিৎসা করানোর জন্য। খালাতো বোনের দুই সন্তানসহ সুখের সংসার। খালাতো দুলাভাই সরকারি চাকরি করেন। ২/১ দিন যেতে না যেতেই দুলাভাই এর নজর পড়লো শ্যালিকার দিকে। বিভিন্নভাবে পটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। যখনি খালাত বোন বাচ্চাদের আনতে স্কুলে যায়, তখনি দুলাভাই হাজির এবং মেয়েটিকে ফিজিক্যাল হ্যারাজমেন্টের চেষ্টা (উল্লেখ্য তখনো স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি)।

মেয়েটি থাকে গ্রামে। দেখতে ফুটফুটে সুন্দর এবং ভদ্র। সে লজ্জায় না পারছে খালাত বোনের সাথে শেয়ার করতে। না পারছে নিজের ফ্যামিলির সাথে শেয়ার করতে (তার কোনো মোবাইল নেই)। আবার সহ্য ও করতে পারছে না। সে নিজেকে যেভাবেই হোক এই পিশাচের হাত থেকে নিরাপদ রেখেছে বেশ কিছুদিন।

কিন্তু পিশাচ দুলাভাই তো পিছু ছাড়ে না। শুধু সুযোগ খোঁজে কিভাবে মেয়েটির সর্বনাশ করা যায়।

অবশেষে মেয়েটি তার বোনকে বললো আমার ট্রিটমেন্টের দরকার নেই। আমি বাড়ি যাব। আর দুলাভাই এর আচরণ সম্পর্কে হালকা টাচ দিলো। বোন বললো যে দুলাভাই তো একটু ফাইজলামি করতেই পারে শ্যালিকার সাথে কিছু মনে করিস না। আসলে বোন ও তার স্বামীর কাছে নির্যাতিত।

তখন আবার লকডাউন পরিস্থিতি শুরু হওয়ায় দুলাভাই প্রাইভেটকার ভাড়া করলো শ্যালিকাকে চাঁদপুরের মতলব তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য।

রওয়ানা হয়ে চাঁদপুর না গিয়ে দুলাভাই তার এক ফ্রেন্ডের বাসায় নিয়ে গেলো কেরানিগঞ্জে। দুলাভাই বললো সে তাকে ভালোবাসে এবং ইসলামি শরিয়া মোতাবেক বিয়ে করতে চায়। মেয়েটি রাজি না হওয়ায় মারধর করলো এবং বললো পৃথিবীর কেউ তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার অনেক টাকা আছে। এখানেই তোকে আজীবন আটকে রাখব। আর তোর ভাইদের মেরে ফেলব কিলার ভাড়া করে।

মেয়েটি এক পর্যায়ে প্রচণ্ড ভয় পেলো। নিজের ভাইদের জীবনের কথা ভাবল। ওদিকে দুলাভাই এর বন্ধু আর তার ওয়াইফ তো সারাক্ষণ লেগেই আছে যে এখানে বিয়ে করো সুখে থাকবা, অনেক টাকা আছে ওর, অনেক ক্ষমতা ও আছে। তোমাকে রাজরানী করে রাখবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এক পর্যায়ে কাজী ডেকে এনে গভীর রাতে মেয়ের অমতে জোর করে সাইন নিলো কাবিননামায়।

মেয়েটি সারারাত কেঁদেছে আর চিৎকার করেছে। যাইহোক সকালে মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে রাজি হলো দুলাভাই। পৌঁছেও দিলো আর বলল বিয়ের কথা কাউকে বলা যাবে না। সময় হলে সে জানাবে আর যদি কাউকে জানায় তাহলে মেয়েটির ভাইদের সে খুন করবে।

তখনো মেয়েটি কাঁদছিলো। কি হয়েছে রাতে, কি হবে সামনে, কি হবে তার বোনের সংসারের, কি হবে তার নিজের জীবনের এগুলো চিন্তা করে।

একপর্যায়ে মেয়েটির মনে হলো এই পিশাচের শাস্তি হওয়া উচিত, ফ্যামিলির সাথে শেয়ার করে বড়ভাইকে সাথে নিয়ে চাঁদপুর থেকে চলে এলো শাহবাগ থানায়। তারপরও মেয়েটির অনেক ভয়। থানায় আসছে জানলে দুলাভাই মেরে ফেলবে। মেয়েটির ভাই এর চোখে মুখেও ভয়, দুলাভাই নাকি টাকা দিয়ে পুলিশও কিনে ফেলবে।

সাথে সাথে ওসিকে মামলা রেকর্ডের নির্দেশ দিলাম, ডিসি স্যারকে জানিয়ে টিম রেডি করলাম। রাত ১ টায় ওই পিশাচকে ধরতে চাঁদপুর রওয়ানা দিলাম করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই। কারণ আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দুলাভাই এর বাড়ি ও চাঁদপুরে। তিনি মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়িতে গিয়েছেন। আমরা ওর বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই বাড়ি থেকে পালিয়েছে কোনোভাবে খবর পেয়ে। পুরা এলাকা তন্ন তন্ন করে (প্রতিটা ঘর) টানা সাত ঘণ্টা শ্রম দিয়ে অবশেষে তাকে পেলাম।

সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা ছোট্ট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক (দেখতে)। বসান দিলাম যাতে ঠিকমতো হেঁটে যেতে না পারে। নিয়ে এলাম ঢাকায় এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহণ করলাম।

শিক্ষণীয়: অভিভাবকেরা মেয়েকে কোথাও পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত মনে না থেকে প্রতিনিয়ত খবর নিন। এ ধরনের দুলাভাইদের কিন্তু অভাব নেই আপনার মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য।

লেখক: সহকারী পুলিশ কমিশনার, রমনা জোন,

ডিএমপি, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :