মান সাকাতা সালিম

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ০৪ জুন ২০২০, ১৯:০৪

আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে- মান সাকাতা সালিম, অর্থাৎ তুমি নীরব রইলে তো নিরাপদ থাকলে। মুখ খুলেছ কি মরেছ। শত্রুরা সব তোমাকে এসে ঘিরে ধরবে, গিলে খাবে। তুমি শ্বাস নেবারও ফুরসত পাবে না। কিন্তু মুশকিল কী জানেন তো, আমাদের রঘুদা মোটে তার মুখে লাগাম দিতে জানে না। যা মুখে আসে তাই বলে, কণ্ঠনালীর যথেচ্ছ অপব্যবহার করে রঘু।

ফলে তার শত্রুর অন্ত নেই, ঘরে-বাইরে দুদিকেই তার মেলা এনিমি, মানে যাকে বলে জাতশত্রু। রঘু উচিত কথা বলে, সে মনে করে যে সত্যের সঙ্গে তার সহবাস, হক-কথার সাথে তার খুব ভাল বোঝাপড়া, সত্য বই মিথ্য বলাটা তাই তাকে মানায় না। সম্ভবত সে ‘লালসালু’ পড়েনি, তাহলে জানতো দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা, বেঁচে থাকতে গেলে সময়ে অসময়ে দুচারটে মিথ্যে না বললে নয়। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের যুগ আর এখন নেই।

এই যে হালে মুখোশ নিয়ে কত কিছু কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি হল, রঘু জানে ওটা বড়দের ব্যাপার- রঘুর সেখানে নাক গলাতে নেই, কিন্তু তাও সে মুখোশের কথা তুলবেই। তার সহ্যশক্তি কম, সে মুখ বুজে এসব সইতে পারে না, তাই কণ্ঠের অপচয় করে। যখন যা মুখে আসে তাই বলে দেয়। নইলে তার বিস্তর বদহজম হয়, অথবা কষা।

তার বসটা যে একটা নির্বোধ, অবিবেচক তাও রঘু বলে মাঝে মাঝে। বসের সামনে তো আর বলতে পারে না, মনের দুঃখ ‘ভেন্টিলেট’ করতে সে বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলে। সে তো রাবণ নয় যে তার দশমাথা, বস কুচুত করে তার একটা মাথা কেটে নিলে সে কথা বলবে কী করে! তার সত্যভাষণ তখন কই যাবে! তাই সে বসকে এড়িয়ে চলে। বস্তুত, বসকে সে ব্যাপক ভয় পায়। ভয় অবশ্য রঘু তার বউকেও পায়, নইলে সংসার চলে কেমন করে! একঘরমে দো-পীর তো চলতে পারে না, তাই না!

ভীতু লোক কীভাবে হক কথা বলে, বুঝতে পারি না বাবা। ভীতু বলে যে রঘুর শরীরে রাগ নেই, তাও কিন্তু নয়। রেগে গেলে রঘু অন্য মানুষ (নাকি বন্য মানুষ!)। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, পেটের ভিতর তার যত সত্যি জমে আছে সবগুলো সে একসাথে উগড়ে দেয়। লর্ড ক্লাইভের আমল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী- সব তার মুখস্থ। টিভিসি’র সেই ফ্রুটিকা খাওয়া বলদের মতো সব কথা সে বলে দেয়। এমন কি, ঘরের কথাও সে বাকি রাখে না। বস্তুত, এমন গাড়ল ও জেদি লোক আর হয় না। রঘুকে তাই সকলে বেশ ভয় পায়, সমঝে চলে। মোটেও তাকে লঘু করে দেখে না। ভাবে, রঘু যদি রেগে যায় তাহলে খরব আছে। মান-ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে খাবে।

একটা কথা প্রায়ই বলে রঘু- আমরা শুধু উন্নয়নের জোয়ারেই ভাসবো, কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারবো না, কারণ আমরা দেশব্যাপী চোরের চাষ করি। চালচোর থেকে শুরু করে ব্যাংকচোরÑ কী নেই আমাদের দেশে! ঘরের ইঁদুরে বাঁধ কাটলে কি আর সেই ঘরে শান্তি থাকে! রঘু আরো বলে যে, এই যে করোনাকাল, ভাইরাসের তো কোনো দোষ নেই, সে নরম মাটি পেয়ে সমানে আঁচড়ায়। আমাদের কোনো আচার-বিচার নাই, আমরা গাদাগাদি করে গণপরিবহনে উঠি, আবেগে গদগদ হয়ে বাড়ি যাই। দর্জিদিদিরা কারখানায় আসবে কি আসবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতেই আমাদের জান জেরবার, ওরা পায়ে হেঁটে আসে-যায়, আর সমানে করোনা ছড়ায়। পোশাকশিল্প ছাড়া নাকি আমরা অচল। আরে ভায়া, জান আগে না উন্নয়ন!

রঘু কিছু বুঝতে পারে না, সে সমানে ঘামতে থাকে, আর দর্জি-মালিকদের তুলোধোনা করে। ওটা অবশ্য মনে মনে, কেননা, তার অত সাহস নেই যে খোলাখুলি সমালোচনা করবে। পাত্তিঅলারা যদি রেগেমেগে তার টুঁটি টিপে ধরে, তখন! বাঙালি আবেগী জাত- সবাই জানে, কিন্তু ওরা যে এমন ধ্বংসকামী, জানা ছিল না রঘুর। করোনাভাইরাসের পিকটাইম চলছে এখন, কোথায় তারা একটু রয়েসয়ে কাজ করবে, বাসায় মুখ লুকিয়ে থাকবে তা নয়, দোকানপাট সব মেলে দিয়ে আরামসে বসে করোনার সঙ্গে দোস্তি করছে!

করোনার কথা উঠলেই রঘুর কারিনার কথা মনে হয়- কারিনা কাপুর! আহ্ কী সুন্দর ডগডগে দেখতে! দুধেআলতা গায়ের রঙ, বাহারি পোশাক, নাচের যা মুদ্রা, আর কী তার ভ্রুভঙ্গি! কিন্তু করোনা এসে রঘুর সেই ভাবালুতা সব ধুয়েমুছে দিয়েছে। একটা শব্দই রঘুর মুখে আসে- করুণা। করুণা ছাড়া আমাদের আর বাঁচার পথ নাই। কারণ আমরা আত্মঘাতী বাঙালি- আমাদের গোড়াতেই গলদ। মার্চের গোড়ায় সেই বাংলিশ বলা ইতালি গ্রুপটাকে যদি লজ্জা না করে সময়মতো গারদে পোরা যেত, তাহলে করোনা হয়তো এভাবে আমাদের বেসামাল করতে পারতো না।

করোনার কীট নিয়েও অবশ্য তেলেসমাতি কিছু কম হয়নি। এই বিষয়েও রঘুর কিছু বক্তব্য ছিল, কিন্তু সে কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কারণ দেশে ‘ঘন-মাধ্যমের’ তো আর শেষ নেই। একেকজন একেক রকম করে বলেÑ কেউ বলে ‘গণ-কীট’ ভালো, কেউ বলে ওটা ত্রুটিযুক্ত। আবা কেউ বলে কীট ভালো তবে তার আবিষ্কর্তা মোটে সুবিধার লোক নয়। কেউ বলে মুগদা যাও, কেউ বলে কুর্মিটোলা। রঘু মনে মনে খুব ভয়ে আছে, কাউকেই সে আর এখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারে নাÑ ভরসা তো দূরের কথা। তার মনে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে চরম নৈরাজ্য বিরাজমান, কিন্তু সে-কথা মুখ ফুটে বলার উপায় নেই, বললেই খনার বচনের সেই খনার মতোন তার আলজিভ কাটা পড়তে পারে।

মজার ব্যাপার এই, আমরা মুখে সবাই সত্যবাদীতার প্রশংস করি, কিন্তু বাস্তবে মিথ্যে শুনতেই বেশি পছন্দ করি। রঘু যদি বলে লোকটা টেরা, তাহলেই সে খেপে যাবে। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে থুতু ছেটে বা দুর্গন্ধ বেরোয়- এই সত্যিটা পাঁচকান করলে সে কি আর তাকে বন্ধুতালিকায় রাখবে, রাখবে না। চোরকে চোর বললে দোষ, কানাকে কানা বলা যাবে না, টেরাকে বলতে হবে ময়ূরাক্ষী, বর্বরকে অতি সভ্যজন না বললেই সে নাখোশ! আবার অনুকরণপ্রিয়, টুকলি করা, বানান, বাগ্বিধি ও বাক্যবিন্যাসে আনাড়ি লেখককে একাডেমি না দিলে চলবে না, তিনি গোস্সা করবেন। নকল করে পাস করা কাউকে ‘ভিচি’ বানানো চাই, আদুভাইকে ডাক্তার, চোদ্দগোষ্ঠী চোর এমন কাউকে বসাতে হবে ভাঁড়ার সামলাতে- রঘু এসব দেখে আর হাসে, কিন্তু কাশে না। কারণ এখন হাঁচিকাশি বারণ। কেশেছো কী মরেছো! তুমি একঘরে, কেউ আর তোমার ছায়াও মাড়াবে না। মারা গেলে লাশও ছোঁবে না।

রঘুর মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা শিয়ালতন্ত্রে বিশ্বাসী। নাকি বাঁদর! বাঁদরের পিঠাভাগের গল্পটা মনে পড়ে রঘুর। এই যে করোনাকাল, চোরের চোট্টামি কিন্তু থেমে নেই। নামকা-ওয়াস্তে ওষুধ দিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল ধরিয়ে দিচ্ছে কিছু হাসপাতাল। রঘু অবাক হয় আর ভাবে- আচ্ছা, ওদের কি একটু মরার ভয়ও নাই! নাকি টাকা নিয়ে কবরে যাবে! করোনা তো কাউকে কোনোরকম ছাড় দেয় না। শিল্পপতি থেকে শুরু করে বনস্পতি, আমলা-নেতা-আমজনতা, করোনার কাছে সবার সমান ট্রিটমেন্ট। এখানে কোনোরকম আদবকেতা কিংবা ‘ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স’ চলছে না। করোনা যারে পায় তারে ছোঁয়- সে পদবী দেখে না, টাকা চেনে না, ক্ষমতার খুঁটি আগলায় না। করোনা বড়ই সমাজতান্ত্রিক ভাইরাস। রঘু সবকিছু বলতে পারে, কিন্তু করোনাকে আক্রমণ করে সে কিছু বলে না। জানের মায়া কার না আছে বলুন! করোনাকে রাগিয়ে দিলে তাকে যদি সে পাকড়াও করে! করবে নিশ্চয়ই, ঘরের বাইরে গেলেই। রঘু তাই ঘরে আছে, চুপচাপ আছে, সে এখন গৃহপালিত স্বামী, হক কথা কম কয়, সে আদুরে বাপ আর নিবিষ্ট পাঠক। বই পড়ে করোনার ভয় দূরে সরিয়ে রাখে রঘু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :