[পর্ব ০২]

তুমি রবে সরবে...

প্রকাশ | ০৬ জুন ২০২০, ১৬:১২ | আপডেট: ০৭ জুন ২০২০, ১৪:৩১

পাভেল ইসলাম

'কামাল চাচাদের মতো গুণীজনদের নিয়ে জীবিত অবস্থায় কেন আলোচনা হয়না! আমরা কেন তাঁদের সামনে নিয়ে আসিনা! মারা যাবার পর কেন!'

মোস্তফা কামাল সৈয়দ স্মরণে এনটিভি আয়োজিত স্মৃতিচারণ মূলক অনুষ্ঠান 'তুমি রবে নিরবে'র শেষদিন অর্থাৎ ৪ জুন কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী এই উক্তিটি করেন। সবার মনের কথাটাই তিনি অকপটে বলে ফেললেন। অসংখ্য শিল্পী কলাকুশলী ও জনপ্রিয় সেলিব্রেটিদের সমন্বিত রূপ একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান।

যাঁর হাত ধরে এতো মানুষ আলোর পথ দেখেছেন, তাঁকেই আমরা অন্ধকারে রাখতে পছন্দ করি! তিনি নিজেও অবশ্য চাইতেন না সামনে আসতে। নেপথ্যে থেকেও একটা মানুষ কীভাবে আলো ছড়াতে পারেন, তিনি তাঁর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।

একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দের বর্ণাঢ্য জীবনকে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তাঁর বহুমাত্রিক জীবন ও কর্ম আমাদের আলোকিত করে, আলোড়িত করে। তিনি যতো বড় হয়েছেন, ততই নত থেকে অবনত হয়েছেন। গ্রহন করতে শিখেছেন, শিখিয়েছেন। যে মানুষ যত বড় হয় তাঁর ছায়া তত বড় হয়, বিনয়ী হয়; তিনিও তাই।

মোস্তফা কামাল সৈয়দ ১৯৪৩ সালের ২১ মে (জাতীয় পরিচয় পত্রে ১৯৪৬, ১৫ জানুয়ারি) ঢাকার তেজকুনি পাড়ার এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি এতোটাই সুন্দর ছিলেন যে, তাঁর বাবা শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন 'লাভলী'।

বড়বেলায়ও আমরা তাঁকে একজন সুন্দর ও পরিপাটি মানুষ হিসেবেই পাই। ছোটবেলা থেকেই তিনি সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, কঠোর নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে উঠেন। মায়ের নাম আমাতুল ওমদা বেগম এবং বাবা সৈয়দ জিল্লুর রহমান। বাবা তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ডেপুটি জেনারেল ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মোস্তফা কামাল সৈয়দ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনে প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন।

২০০৪ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের উপ মহাপরিচালক হিসেবে সেচ্ছায় অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত টেলিভিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরে যাবার পরপরই তিনি এনটিভি'র অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু তিনি এই চ্যানেলটির সঙ্গেই ছিলেন। তাঁর কর্মদক্ষতা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কল্যানেই এনটিভি আজ দর্শকের কাছে একটি রুচিশীল চ্যানেলের আদর্শ উদাহরণ।

তিনি একাধারে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নাটকে নিয়মিত কন্ঠ দিতেন। আব্দুল্লাহ আল মামুনের অনুপ্রেরণায় তিনি বেশকিছু বছর নাট্যদল 'থিয়েটার' এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মঞ্চ নাটকে আবহসংগীত ও আলোক সম্পাতের কাজ করতেন।

৭০ দশকের শেষের দিকে তাঁর প্রযোজনায় মমতাজ উদদীন আমহদের লেখা নাটক 'প্রজাপতি মন', ৮০ দশকের শুরুতে আন্তন চেখভের গল্প অবলম্বনে মমতাজ উদদীন আহমদের লেখা 'স্বপ্ন বিলাস', 'নিলয় না জানি', 'বন্ধু আমার', 'নিরবে নিঃশব্দে, কাজী আব্দুল ওয়াদুদের লেখা 'নদী বক্ষে' উপন্যাসের নাট্যরূপ 'কূল নাই কিনার নাই' প্রশংসিত হয়। আশির দশকের শুরুর দিকে বিটিভি'র নাটকের শুরুতে সূচনা সঙ্গীতের পাশাপাশি ভূমিকা কিংবা পুরো নাটকের সারমর্ম সূচনা পর্বে নেপথ্য কন্ঠ ভেসে আসতো।

অনেক সময়ই নাটকের শেষে নেপথ্যে থেকে কিছু না বলা কথা প্রচার হতো। সে সময় বেশিরভাগ নাটকের ভূমিকায় বা উপসংহারে শোনা যেতো মোস্তফা কামাল সৈয়দের কন্ঠস্বর। ১৯৭৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃত স্বরূপ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, নাট্যসভা পুরস্কার, শের-ই-বাংলা স্মৃতি পুরস্কার ও টেনাশিনাস নাট্য পুরস্কার অর্জন করেন।

৫২ বছরের সংসার জীবনে তাঁর সহধর্মিণী হিসেবে পাশে ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী জিনাত রেহানা। তাঁদের একমাত্র ছেলে রেহান কামাল সৈয়দ ৩ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। একমাত্র মেয়ে রেহনুমা কামাল আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক। তাঁর স্বামী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সিনিয়র পাইলট। তাঁদের ঘরে রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে।

তিনি সেই ব্যক্তি যাঁর তত্বাবধানে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্যাকেজ নাটকের সূচনা হয়। তিনিই প্রথম সঙ্গীতানুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমে রেকর্ডিং ও পরে লিপসিং করার নিয়ম শুরু করেন। ক্রিকেট পাগল এই মানুষটি টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা প্রচারের ক্ষেত্রেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনিই প্রথম সৃষ্টিশীল কাজে দক্ষতা প্রমাণ করার উদাহরণ তৈরি করেন। এতো গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও কীভাবে মোবাইল ফোন ছাড়া জীবন কাটিয়ে দিলেন, সেটা জানতে একবার বিবিসি বাংলা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে হাজির হয় এনটিভি কার্যালয়ে।

(মোস্তফা কামাল সৈয়দের ব্যাক্তিগত ওয়েবসাইটঃ www.mustafakamalsayed.com)

লেখক: গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ঢাকাটাইমস/৬জুন/এসকেএস