মেলবোর্ন থেকে খোলা চিঠি: করোনাকালীন যুদ্ধ ও নৈতিকতা

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০৭ জুন ২০২০, ০৮:৩৯

বিগত এক যুগ ধরে বিশ্বের সেরা শহর মেলবোর্ন। ঘাতক করোনাভাইরাস এই সেরা শহরে কিভাবে এসেছিলো তা কেউ জানে না। তবে এটি বিদেশ থেকেই এসেছে। ৫ মার্চ ২০২০ তারিখ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীর সন্ধান মেলে। এরপর শুরু হয় শহরকে রক্ষার তাগিদ।

লকডাউন করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, ব্যাপকহারে টেস্ট করে, মহামারি ঠেকানোর প্রচেষ্টা ও জনগণের সহযোগিতা দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো বিষয়। আজ সকাল বেলা পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোতে একটি আনন্দের খবর! আজ প্রথম কোনো কোভিড-১৯ পেশেন্ট পাওয়া যায়নি। এরকম সুখবর অন্য স্টেটগুলো আগেই পেয়েছে। মেলবোর্ন সবার শেষে সুখবরটি পেলো।

এমনি একটি সুখবর সারা বিশ্বের মানুষ অপেক্ষা করছে বিগত ৫ মাস। সকলে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে এই মহামারি ঠেকানো যায়। বাংলার মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে এমনি একটি খবর শুনবার জন্য দেশের প্রান্তে প্রান্তে, বিদেশের শহরে, শহরে। বঙ্গবন্ধুর মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলবেন আমরা আজ মুক্ত! জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবে। সেই দিনটির অপেক্ষায় ১৬ কোটি প্রাণ।

এরই মাঝে বিশ্বব্যাপী নতুন আন্দোলন: Black Lives Matter. এই আন্দোলনে যোগ দিতে মন চায়। গত ৫ জুন রাতেও খবর ছিল: নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে এই প্রোটেস্টকে অবৈধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আবেদন করেছে। কারণ সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি জারি আছে। সকালে সুখবরের পাশাপাশি দুঃসংবাদও ছিল: সুপ্রিম কোর্ট প্রটেস্টকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আর প্রোটেস্ট অর্গানাইজাররা কোনো বাঁধা মানবে না জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ভাবছি কি করা যায়।

আমার ছেলে বললো: “আমরা মেলবোর্ন এর প্রটেস্টে যেতে পারি। ভিক্টোরিয়ার পুলিশ বলেছে তারা বাধা দেবে না। আর যদি স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করে, তবে আয়োজকদের তারা জরিমানা করবে। এ লেখা যখন লিখছি তখনও কাউকে জরিমানা করা হয়নি।

আর নিউ সাউথ ওয়েলসের সুপ্রিম কোর্টের নতুন আদেশে আয়োজকরা বিজয়ী হয়েছেন। সেখানেও সমাবেশ হয়েছে। এবং সারা অস্ট্রেলিয়ায় এই আন্দোলন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা আশায় বুক বাঁধছে- তারা ন্যায়বিচার পাবে। আমি আমার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে প্রোটেস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছি। আমার বিশ্বাস- বর্ণবাদ নিপাত যাবে-আমরা ন্যায়বিচার পাবো।

২০০১ সালের ৯/১১ র পর আমরা অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছি অস্ট্রেলিয়াতে। অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে এসেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া একটি আংশিক স্কলারশিপ পেয়ে; জমানো সব টাকা খরচ করে উচ্চ শিক্ষার আশায় এখানে আসা। কিন্তু যেমনটি মনে করেছিলাম, তেমনটি বিদেশ নয়। ভেবেছিলাম কাজ করে পড়াশোনা করতে পারবো। কিন্তু সে গুড়ে বালি! কাজ পাওয়া খুবই কঠিন। একজন পরিচ্ছিন্ন কর্মীর জন্যও ভাইভা দিতে হয়! এতো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও একটি কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই অধিকারটিও কেড়ে নেয়া হয় ৯/১১-র দোহাই দিয়ে। এমন অবিচার মেনেই বেঁচে থাকার চেষ্টা। এরই মাঝে আমাদের সন্তানের আগমন। একটি সুখবর!

আমার ছেলেটিই আজকে নিজের ইচ্ছায় যেতে চাচ্ছে। আমি আরো উৎসাহ পেলাম। আমার মনে হলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অংশীদার হলাম। নিজের মনে ভালো লাগলেও দেশের অবস্থা দেখে ভালো লাগছে না! মানবতা যেন রিক্ত। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে মানুষ ছুটছে একটি ICU বেড পাওয়ার জন্য। যশোর থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ডক্টরকে নিয়ে আসা হচ্ছে ঢাকায়। নিজে ডাক্তার হয়ে নিজের কর্মস্থলে থাকা ICU তে জায়গা না পেয়ে সিলেট থেকে ঢাকায় ছুটেছেন আরেক ডাক্তার। আজ ৭ জুন। ঐতিহাসিক ৬ দফার দাবি জানিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বীজ বপন করেন বাঙালির চেতনায়। পাকিস্তানিদের সৃষ্ট বৈষম্যর অবসান ছিল ছয় দফার স্পিরিট। আজ Black lives matter আন্দোলনে যোগ দিয়ে ওই বৈষম্য অবসানের দাবিতে পুরো পরিবারের নাম লিখে এলাম। সেখানে অনেক সাদা মানুষও আছে। তারা ২০০২-২০০৩ সালে আফগানিস্তানে, ইরাকে সৈন্য প্রেরণ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। তারা বর্ণবাদের বিপক্ষেও থাকেন। তারাই রায় দিয়ে ভূমির অধিকার দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এবোর জিনিয়ালদেরকে। যেমনটি শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন। তারাই ‘সরি’ বলেছেন জাতীয় সমাবেশ করে, সিডনির হারবার ব্রিজ প্রদক্ষিণ করে।

সাদাদের এই ভালোবাসা যেন সকলের মাঝে ছড়িয়ে যায় আজকের সমাবেশর পর। যেন বর্ণবাদ না থাকে যেমনটি আশঙ্কা করে চীন, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করতে তার নাগরিকদের সতর্ক করেছে। চীনা বন্ধুদের কাছে আবেদন থাকবে: মেলবোর্নের বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি না হয়।

বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো প্রতিদিনই করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারি দমনের খবরের মাঝে নানা বৈষম্যের কথাও বলছে। আমি এই বৈষম্যের শিকার নানা সময়ে। আর তাই আমার গবেষণা হলো জাস্টিস নিয়ে। আমি রাজনীতিও করি ওই বৈষম্যকে বিতাড়নের জন্য। সুতরাং বৈষম্যের খবর আমাকে ব্যথিত করে। আজকেও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম ফেসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে ওই বৈষম্যের কথা লিখেছেন। এপ্রসঙ্গে আমরা মেডিকেল এথিক্স এর উপর লেখা গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে একটি পদ্ধতির কথা জানি। সেটাকে Triage পদ্ধতি বলে।

এই পদ্ধতির আবিস্কারক নেপোলিয়ান যুদ্ধের ফরাসি ডাক্তার ডমিনিক জিন ল্যারি। তিনি বলেন "treat[ed] the wounded according to the observed gravity of their injuries and the urgency for medical care, regardless of their rank or nationality".ডাক্তার ডমিনিকের দেয়া এই পদ্ধতি সারা বিশ্বে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। যে বিচারকরা ন্যায় নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেন তারাও ভুলে যান এই পদ্ধতির কথা। বিশেষ সুবিধার জন্য ওনারা ভি আই পি হয়ে হাসপাতালে আসেন। অথচ ডাক্তার ডমিনিক স্পষ্টতঃ বলেছেন, জাতীয়তা বা পদ নয় ডাক্তার রোগীর সেবা করবেন রোগীর ক্ষত এবং গ্রাভিটি বিবেচনা করে। আর সেজন্য তিনি রোগীদের মাঝে তিনটি বিভাজন তিনি করতে পারবেন।“ ১. Those who are likely to live, regardless of what care they receive; ২. Those who are unlikely to live, regardless of what care they receive; ৩. Those for whom immediate care may make a positive difference in outcome.”

কিন্তু বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো এসবের প্রতি কোনো তোয়াক্কা করছে না বলে অভিযোগ আসছে। এরকম একটি পদ্ধতি আমাদের সরকার আইন করে দিতে পারে। কিন্তু সেটা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে না বলেই যে বৈষম্যমুক্ত সমাজের জন্য বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন তা বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের চেতনা থেকে হারিয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

অনেকেই বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ডাক্তার ও নার্সসহ ওই বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের পিয়ন দারোয়ান হয়েছেন। কিন্তু সেখানে কি দুর্নীতি ও অরাজকতা, পুকুরচুরি হয়েছে তা বর্ণনাতীত। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় দিয়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির রায় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিচারক আক্ষেপ করে বলেন, তার প্রণীত স্বাস্থ্যআইন ৭ বছর আলোর মুখ দেখেনি। কি দুর্বিসহ যন্ত্রণা তিনি বুকে চেপে থাকেন তা কেবল তার কাছের মানুষই জানেন।

আমরা এসব আর নিতে পারছি না! আর তাই জর্জ ফ্লয়েড এর মতো বলতে হয় I cannot breathe. আমি আজকের প্রোটেস্ট মুভমেন্টে যাবো কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম। আমার ছেলে কোরআন থেকে একটি আয়াত শুনিয়ে বললো: সূরা আল বাকারাতে ১৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, নিপীড়ন হত্যা চেয়ে খারাপ। জর্জকে যেভাবে গলাচেপে ওরা মেরেছে, চীনা বন্ধুদের বলতে চাই, সেভাবে করোনাভাইরাস আমাদের গলাটা চেপে ধরেছে। আমরা কেউ নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, তীর কোথা থেকে এলো সেটা না খুঁজে রোগীর সেবা করো। ডোনাল্ড ট্রাম্প তীর খুঁজতে গিয়ে লক্ষ আমেরিকানের প্রাণহানির কারণ হয়েছেন। এখান থেকে যেন আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

আর চীনের ২৫ কোটি বৌদ্ধ যেন তাদের সরকারকে বোঝায় কি যাতনা বিষে। তারা যেন মানবতাকে ভুলে না যায়। সারা বিশ্ববাসী তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পায়। তারা যেন মানবতাকে বিসর্জন না দিয়ে বিবাদে জড়িয়ে না পড়ে। বিশ্ববাসী তাদের কাছে একটা ক্ষমা প্রার্থনার দাবি পেশ করতেই পারে।

আগামী ৮ তারিখ চীন থেকে একটি দল বাংলাদেশে আসবে। আশা করি চীন দ্রুত আরো টেস্টিং কিট ও পিসিআর মেশিন দিয়ে বাংলাদেশকে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় বিশেষ অবদান রাখবে। তারা মিয়ানমারকে চাপ দেবে যেন রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে বাস করতে দেয়। নুতুবা তাদের সকল সৃষ্টি ঘৃণার বিষয় হয়ে মানুষের মনে টিকে থাকবে! ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে তারা কোনো শান্তি পাবে কি?

চাইনিজ বন্ধুদের বলতে চাই, আমি তোমাদের সন্তানদের মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় অনেক যত্ন করে পড়িয়েছি। আমি দেখেছি অস্ট্রেলিয়ানরা তোমাদেরকে ভালোবাসে। সুতরাং তোমরা যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছো তা কিন্তু তোমাদেরকে ভালো কিছু দিতে পারবে না। তোমরা অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রীদের ফোনের জবাব দিতেও চাও না। কেন? তোমাদের বন্ধুত্বের সীমানায় কেন উচ্চ প্রাচীর রচনা করছো? তোমাদের নেতা মাও এর উপদেশ ছিল এরকম: "When the enemy advances, we retreat.

When the enemy rests, we harass him. When the enemy avoids a battle, we attack. When the enemy retreats, we advance."যুগ বদলে গেছে- বললে ভুল হবে কি? পৃথিবীর মানুষ শান্তি চায়, যুদ্ধ নয়। তোমাদের চেতনায় মানবতা যেন সর্বোচ মর্যাদা পায়। তোমরা ফিরে যাও ভারত সীমান্ত থেকে নিজের ব্যারাকে। শান্ত হোক ভারতবাসী সামিল হোক তোমাদের মাটি থেকে আসা করোনাভাইরাস থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্ত করবার যুদ্ধে। যুদ্ধ হোক মানবমর্যাদার জন্য। শান্তির দুয়ার খুলে যাক এখনই। মানুষকে যেন আর না বলতে হয়: I cannot breathe. এই নৈতিক অবস্থান থেকে তোমরা সরে যেও না।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :