মানুষকে মানুষ ভাবুন, মানুষ হোন

শর্মি ভৌমিক
 | প্রকাশিত : ০৭ জুন ২০২০, ১১:৩২

শুধু নারী কিংবা পুরুষ কেন, উভয় লিঙ্গের অধিকারী যারা তারাও মানুষ। জন্মের দায় তো একটি শিশুর নয়! তাহলে তাকে কেন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেবলমাত্র পুরুষরাই সবকিছুতে এগিয়ে আছে, তারাই যেন মুক্ত স্বাধীন! নারীদের প্রতি পদেই বাধা আর বাধা। তারা আজ পর্যন্ত যা কিছু পেয়েছে সেসব তাদেরকে বিদ্রোহ করে, যুদ্ধ করেই অর্জন করতে হয়েছে। পুরুষদের মত তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। কোনকিছুই তারা রেডিমেড পায়নি।

আমি জীব ও জগতকে নিয়ে চর্চা করি। আমার নিকট কে নারী, কে পুরুষ, কে হিজড়া- এসব বিবেচ্য নয়। আমি মানুষ বুঝি। লিঙ্গ দিয়ে মানুষ শব্দটিকে সীমাবদ্ধ করার ঘোর বিরোধী আমি। যেখানে কোন মানুষ বৈষম্য বৈরীতার শিকার হবে সেখানেই আমার অবস্থান। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষেরই শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা রয়েছে। যথাযথ সুযোগ পেলে তারা সেসবের প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের সম্মুখে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু, সেই সুযোগ কি সকলে পায়? সেই যথাযথ সুযোগ কি আমরা তাদেরকে দিই? আমরা কী লিঙ্গভেদ করি না?

একটি কন্যা সন্তান জন্মের পর থেকেই পরিবার থেকে কিছু কমন কথা শুনতে শুনতে বড় হয় । যেমন, তুমি মেয়ে, তোমাকে ঘরে থাকতে হবে, তোমার দৌড়াদৌড়ি করা বারণ, জোরে হাসা বারণ, খেলতে নেই, পড়ার চেয়ে ঘরকন্নার কাজ করা তোমার জন্য বেশি প্রয়োজন, মাছের মুড়োটা তোমার জন্য নয়, তোমার ভাই কিংবা পিতার জন্য, ইত্যাদি হাজারো বৈষম্যমূলক কথা শুনে ও মেনে নিয়ে বড় হতে থাকে একটি কন্যা শিশু। তার কচি মাথায় ঢুকানো হয় জটিলতর ভাবনাগুলো। কন্যারা পরিবারের এসব নিয়মগুলোকে স্রষ্টার আদেশ হিসেবে মগজে ঢুকিয়ে নেয় ক্রমাগত। অথচ, পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে এসবের কোন বালাই-ই খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা এই পৃথিবীর সবচাইতে মুক্ত-স্বাধীন, বাঁধনহারা!

নারীদের সম্পর্কে অধিকাংশ পুরুষেরই দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন। তাদের নিকট নারী মানে একটি শরীর। একটি যৌনাঙ্গ কিংবা কিছু মাংসপিণ্ড। নারী শরীর তাদের নিকট শুধুমাত্র উত্তেজনাকর একটি বিষয়। একবার আমার এক কাছের মানুষের নিকট থেকে জানতে চেয়েছিলাম সুন্দরী নারী সম্পর্কে তার অভিমত কী। উত্তরে সে বলেছিলো, পুরুষদের নিকট নারী মানেই বিছানাসঙ্গী। বেডে পেতে চাওয়া। সুন্দরী নারী হলে তো সোনায় সোহাগা, সেক্ষেত্রে আনন্দটা বেড়ে হয়ে যায় দ্বিগুণ! অর্থাৎ, আমার বন্ধুটির দৃষ্টিতে নারী মানেই হলো যৌনতা। তার নিকট ভোগবিলাস ব্যতীত কিছুই নয় একজন নারী। তার দৃষ্টিতে পরিবার, অফিস, আদালত, এবং পার্কেও একই চিত্র, এর বাইরে আর কিছুই নেই।

একজন দেখতে অসুন্দর পুরুষ একজন সুন্দরী নারীকে বিয়ে করলে সেই এলাকার পরিচিত মহলে রব ওঠে "গরীবের বউ সকলের ভাবী" টাইপের। অর্থাৎ, সেই অসুন্দর লোকের স্ত্রীকে সকলে নিজেদের ভোগ্যবস্তু মনে করার স্বাধীনতা রাখে। এলাকার সকল লম্পটই তখন সুন্দরী বউটিকে ভোগ করার সুযোগে থাকে। তাদের উদ্দেশ্যই নারীটিকে ছলে, বলে, কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলা। আমার বাস্তব জীবনে আমি এরকম দু'একটি ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করেছি। পুরুষের নিকট নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। দু'চারজন ভালো পুরুষ যে নেই তা নয়, তবে অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য অসততায় ভরপুর। নিজের পরিবারের নারীগুলোকে ছাড়া তারা যেন আর সকলকে শয্যাসঙ্গীনী মনে করে খুব সহজে!

কিছু পুরুষ মানুষের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায় হঠাৎ অর্থের মালিক হয়ে উঠলে। বিশেষ করে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় তাদের বেলায় উপরোক্ত কথাটি বেশি করে প্রযোজ্য। প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থের মালিক হলে পরে তারা তখন নারীলোভী হয়ে ওঠে। অর্থের বিনিময়ে নারীর শরীর ভোগ করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে তারা। যেন জীবনের লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে তাদের! বুড়োভাম টাইপ পুরুষগুলো এসবে আসক্ত হয়ে ওঠে মাদকাসক্তির মত করেই। নারীদেহ আর মাদক তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে অস্বাভাবিকভাবে। তারা আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় না। অন্যদিকে, সংসার ডুবে যায় অশান্তির করাল গ্রাসে। ছেলে-মেয়েরাও জড়িয়ে পড়ে উশৃঙ্খল জীবনযাপনে। সুখের সংসারটি খুব দ্রুতই পরিণত হয় বিভীষিকাময় এক জ্বলন্ত নরককুণ্ডে।

খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে প্রায় প্রতি ঘরের গল্পই একরকম। পুরুষেরা যৌবনে স্ত্রীকে ভালোবাসলেও স্ত্রীর যৌবন ফুরিয়ে এলে কচি নারী খুঁজতে তাদের লোভী মন শেয়ালের মত ধূর্ত হয়ে ওঠে। তখন নিজ কন্যার বয়সী মেয়ের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতেও তাদের এতটুকু বাধে না রুচিতে। তাদের যে বৈচিত্র্য চাই! এক্ষেত্রে কিছু নারীও কম দোষী নয়। তারা সুযোগ না দিলে পুরুষগুলো কী করে এসব অপকর্ম করতে সক্ষম হতো! কিছু নারী স্বভাবগতভাবেই চরিত্রহীন ও লোভী হয়। তারা আসলে বাপ কিংবা ভাই বোঝে না। তারা বোঝে টাকা।

টাকার জন্য তারা এহেন কর্ম নেই যা করতে পারে না। এইসমস্ত অসৎ নারীদের জন্য ভদ্র নারীদের সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কারো কারো সংসার থাকলেও সেই সংসারে থাকে না সুখের লেশমাত্রও। অশান্তির আগুনে পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যায় নিষ্পাপ জীবনগুলো। কথায় আছে, "একে পাপ করে, দশে পুইড়া মরে"। এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে সকলকে। জীবনটা শুধুমাত্র জৈবিকতার নয়। অহেতুক, অযৌক্তিক যৌনতাকে কন্ট্রোল করতে হবে মানুষকে। মেডিসিন ব্যবহার করে বাজারের মেয়েদের নিকট পুরুষত্ব ফলানোর প্রয়োজন আছে কি? নেই তো! তবুও এসবে আসক্ত হয় কেউ কেউ। কারণ জানা নেই আমার!

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা খুব প্রয়োজন। এক জনের প্রতি আরেকজনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও ভরসা না থাকলে দাম্পত্য জীবনের কোন মানে থাকে না। এগুলো থাকা ভীষণ জরুরী। পরিবারের মত সুখ আর কোথাও কী আছে? না, নেই। কখনোই থাকে না। তারপরও মানুষ ভুল পথে হেঁটে চলে শুধু।

একসময় জীবনের মূল্যবান সময়গুলো খুইয়ে পুনরায় পরিবারের কাছেই ফিরে আসে, কিন্তু তখন আর সময় থাকে না। অনেক কিছুই হারিয়ে যায় তাদের জীবন থেকে। অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে যায় তাদের জীবনে যা কোনোদিন ঠিক হবার নয়। ভাঙ্গাচোরা বিশ্বাস নিয়ে কোনরকম বেঁচে থাকলেও আর সুখে থাকা হয় না কখনও। শান্তির পায়রা চিরতরে উড়ে যায় তাদের চেনা পৃথিবী ছেড়ে।

নারী, পুরুষ ছাড়াও আমাদের পরিবারে কিছু উভয় লিঙ্গের মানুষের জন্ম হয়। তাদের জন্মে পিতামাতাও খুশি হন না, উপরন্তু অভিশাপ মনে করেন সেইসব শিশুর আগমনকে। শুধুমাত্র লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে তারা মানুষ থেকে আলাদা প্রাণীতে পরিগনিত হয় মানুষের কাছে। পিতামাতার লজ্জায় পরিণত হয় একটি হিজড়া শিশু। তাই নিজ পরিবারেও তার স্থান হয় না। তাকে আশ্রয় নিতে হয় হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

হিজড়াদের দলে নেচে, গেয়ে ভিক্ষা তুলে মানবেতর জীবন কাটাতে হয় তাকে। অথচ, তার হাত ছিল, পা, চোখ, মুখ, মাথা, ব্রেইন সবই ছিল। তাকে সুযোগ দিলে সে ডাক্তার হতে পারতো কিংবা হতে পারতো ইঞ্জিনিয়ার। সুযোগ পেলো আর সব মানুষের মত সেও যা ইচ্ছে তাই হতে পারতো। কিন্তু, আমাদের সমাজ হিজড়াকে হিজড়া করে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে মানুষ। এটা বড্ড হতাশাব্যাঞ্জক ও দুঃখজনক ব্যাপার।

শুধুমাত্র লিঙ্গের কারণে একজন মানুষকে কেন নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হবে! তারও তো স্বাভাবিক জীবনের অধিকার রয়েছে। সেও তো দেশ, সমাজ এবং পরিবারের সম্পদ হতে পারে। তাকে কেন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে? এ বৈষম্যের শেষ কোথায়? কেন এ বৈষম্য নিপাত যাবে না? প্রশ্ন রইলো দেশ, সমাজ, পরিবার ও আপনাদের কাছে।

লেখক: কবি

ঢাকাটাইমস/৭জুন/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :