যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ মানুৃষ হত্যা করলেও দোষী সাব্যস্ত হয় না কেন?

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২০, ১১:৪৮

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস

আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বছর পুলিশের হাতে মারা যায় ১,২০০ ব্যক্তি। কিন্তু ৯৯ শতাংশ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয় না।

মিনেসোটায় পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যে ব্যাপক প্রতিবাদ ও দাঙ্গা হয়েছে তাতে গণচাপের মুখে এবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।এদের মধ্যে ডেভিড শওভিন নামে একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যার অভিযোগ, যা পরিকল্পিত ছিল না।

এই পুলিশ অফিসার ২৫শে মে মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে ফেলে তার হাঁটু দিয়ে ফ্লয়েডের গলা চেপে ধরেছিল প্রায় নয় মিনিট ধরে।

আরও তিনজন পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়েছে শওভিনকে সহযোগিতা করার ও অপরাধে মদদ জোগানোর দায়ে। দোষ প্রমাণিত হলে চারজনেরই সর্বোচ্চ চল্লিশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

বিক্ষোভকারীরা আশা করছে ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ অফিসার কাউকে হত্যা করলে আইন তার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রযোজ্য হবে তাতে একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। কারণ তাদের আশা ফ্লয়েডের ঘটনা খুবই ব্যতিক্রমী।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইনে, পুলিশ অফিসারদের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আইনি সুরক্ষা রয়েছে।

 

পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা 'খুবই বিরল'

পুলিশের সহিংস আচরণের খতিয়ান পর্যবেক্ষণকারী একটি প্রকল্পের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৭,৬৬৬। এর মধ্যে মাত্র ৯৯টি ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে , যা মোট হত্যার ঘটনার মাত্র ১.৩%। এবং এর মধ্যে মাত্র ২৫টি ঘটনায় পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।

ওয়াশিংটনে কেটো ইন্সটিটিউটের ফৌজদারি বিচার বিষয়ক বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লার্ক নেইলি বলেছেন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কৌঁসুলিদের ফৌজদারি মামলা দায়েরের ঘটনা খুবই বিরল। ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

তিনি বলেছেন এর কারণ পুলিশ এবং কৌঁসুলি দুজনেই আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থার অংশ- তারা পরস্পরের সহযোগিতায় কাজ করে । অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ এবং মামলার সময় আদালতে সেগুলো পেশ করার ব্যাপার কৌঁসুলিরা পুলিশের ওপরই নির্ভর করেন।

তাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই ব্যবস্থায় ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তাদের দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। এছাড়াও শক্তি প্রয়োগের অধিকার আইনত পুলিশকে দেয়া আছে। যেমন আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষায়, অথবা অন্য কারো মৃত্যু ও গুরুতর আহত হওয়া ঠেকাতে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

 

মামলা থেকে সুরক্ষা

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে আইনি রক্ষাকবচ থাকায় পুলিশি বর্বরতার শিকার মানুষের জন্য একটাই পথ খোলা থাকে - সেটা হল দেওয়ানি আদালতে মামলা আনা। কিন্তু  নেইলি বলছেন, বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা আনার জন্য দেওয়ানি আদালতের দরজা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে, কারণ এক্ষেত্রে বিশেষ রক্ষাকবচের নীতি তুলে ধরার রেওয়াজ রয়েছে।

তিনি বলছেন ক্ষতিগ্রস্তের সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকার বলে আইনের নথিতে যদি কিছু লিপিবদ্ধ না থাকে, তাহলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন একরকম অসম্ভব। তার থেকেও বেশি কঠিন এধরনের মামলা দায়ের করা সম্ভব হলেও, তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়।

২০১৪ সালে, এমি করবেট নামে এক নারী এক ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে এক ব্যক্তি তার পেছনের বাগানে ঢুকে পড়ে। তার বাগানে সেসময় ছয়টি শিশু খেলা করছিল। সশস্ত্র পুলিশ বাগানে ঢুকে বাচ্চাদের মাটিতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়।

আদালতের নথিপত্র অনুযায়ী, এসময় এমির পোষা কুকুর ব্রুস বাগানে বেরিয়ে এলে একজন পুলিশ অফিসার কোনরকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই কুকুরকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি চালায়, যদিও কুকুরটা তার জন্য কোনরকম হুমকির কারণ ছিল না।

কুকুরের গায়ে গুলি না লাগলেও গুলি লাগে এমির দশ বছরের ছেলে ডাকোটার পায়ে। ডাকোটা মাটিতে শোয়া অবস্থায় ছিল। ছেলেটি প্রাণে বেঁচে যায়, কিন্তু সে গুরুতর আহত হয় এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করে এমি ব্যর্থ হন। আদালত তার আবেদন নাকচ করে দেয় এই যুক্তিতে যে, গ্রেপ্তারের সময় শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত এই ঘটনা ঘটেছে এবং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকারের লংঘন নয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল মালাইকা ব্রুকসের প্রতি পুলিশি আচরণ। তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে তার ওপর তিনবার টেজার অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যাতে তার নড়াচড়ার শক্তি না থাকে। তাকে মুখ নিচে করে মাটিতে শুইয়ে ফেলা হয় এবং তার ১১ বছরের ছেলের সামনে তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। মালাইকা তখন আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলেন।

যে রাস্তায় ঘন্টায় বিশ মাইল বেগে গাড়ি চালানোর নিয়ম, সেখানে মালাইকা বিশের জায়গায় ৩২ মাইলে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে পুলিশ স্পিড করার জন্য জরিমানার কাগজ ধরিয়ে দেয়। নিজের দোষ স্বীকার করার ভয়ে মালাইকা ওই কাগজে সই করতে অস্বীকার করেছিলেন।

তিনিও পুলিশ অফিসারকে আদালতে নিতে ব্যর্থ হন। কারণ টেজার গান ব্যবহার করার ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকার কী তার কোন রূপরেখা না থাকায় আদালত মামলার আবেদন নাকচ করে দেয়। দশ বছর পর মালাইকাকে আদালতের বাইরে ৪৫ হাজার ডলারের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।

নেইলি বলেন, 'আদালত পুলিশকে যে এভাবে কী পরিমাণ স্বাধীনতা দিচ্ছে তাদের ইচ্ছামত আচরণ করার, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আমি এটাকে বলব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রায় কোনভাবেই দায়বদ্ধ না করার একটা নীতি।'

জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার ন্যায় বিচার

নেইলি বলছেন পুলিশের জন্য যে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচ রয়েছে তার কারণে ফ্লয়েডের পরিবারের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়া কঠিন হতে পারে। তারা দেখবে আদালতে এমন কোন মামলার নজির আছে কি না, যেখানে কারো মেরুদণ্ডের ওপর নয় মিনিট ধরে হাঁটু দিয়ে চেপে বসে থাকা, যতক্ষণ না সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে এবং পরে মারা যাচ্ছে - এমন ঘটনা অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত হয়েছে। এমন নজির যদি না থাকে, তাহলে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচের সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি পুলিশের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কারণ এমন কোন ঘটনা আইনত নথিভুক্ত নেই।

আমেরিকার জাতীয় পুলিশ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বিবিসি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আগে এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট মাইকেল ম্যাকহেল বলেছিলেন, জর্জ ফ্লয়েডের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা মর্মান্তিক। পুলিশ অফিসারের আচরণের পেছনে কোন আইনগত, আত্মরক্ষামূলক, নৈতিক কোনরকম যুক্তি থাকতে পারে না। রাজনীতিকরাও একই সুরে কথা বলেছিলেন।

গণমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুলিশের জন্য এই সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচের নীতির বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনা করা উচিত। পুলিশ কোন্ পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী হতে পারে এমন মাত্রার বলপ্রয়োগ করতে পারে সে বিষয়ে কংগ্রেসে আইন পাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনকর্মীরা।

ঢাকা টাইমস/০৭জুন/একে