করোনামুক্ত বস্তিগুলো এখন সংক্রমণের শঙ্কায়

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২০, ১২:৩৪

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেলাগাম বেড়ে চলেছে। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। স্বস্তির বিষয় হলো, রাজধানীর বস্তি এবং নিম্নআয়ের মানুষের বসবাসের এলাকাগুলো নিয়ে যে বড় আশঙ্কা ছিল, সেটি ঘটেনি। এখনো প্রায় করোনামুক্ত এসব এলাকা।

এত দিন সংক্রমণ না হলেও এসব এলাকা এখন সংক্রমণের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের মতে, বাংলাদেশে করোনার প্রবেশ মূলত ইতালিফেরত প্রবাসীদের মাধ্যমে। তাদের পরিবার ও স্বজনদের মাধ্যমে আশপাশে প্রথমে ছড়িয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও বস্তিতে তাদের যাতায়াত ছিল না বলে সেখানে এত দিন সংক্রমণ ঘটেনি। ইতিমধ্যে ভাইরাসটির কম্যুনিটি সংক্রমণ শুরু হওয়ায় বস্তির বাসিন্দাদের এখন অতি সতর্ক থাকতে হবে।

এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব যথাসম্ভব পরিপালনের ওপর গুরুত্ব দিতে বলছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে বস্তিতে বাইরের মানুষের প্রবেশেও নজরদারি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

মহানগর ঢাকাতে রয়েছে শতাধিক বস্তি। সেখানকার ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করেন লাখ লাখ মানুষ। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর বস্তিতে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস এমন জায়গায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার কম।

মোহাম্মদপুর এলাকার মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৫ নম্বর রোডের বস্তির বাসিন্দা রানী ঢাকাটাইমসকে জানান, তাদের বস্তিতে ২৬টি পরিবারের বসবাস। তারা সবাই করোনামুক্ত আছে।

একই তথ্য জানান এলাকার বাঁশবাড়ি বস্তির বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন। বস্তিটিতে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা চার শতাধিক। কাঁটাসুর বস্তিতে এখনো কোনো কোভিড=১৯ রোগী শনাক্ত হয়নি বলে জানান সেখানকার শামসুদ্দিন। নবোদয় হাউজিং বস্তিতেও করোনার আক্রমণ ঘটেনি।

মোহাম্মদপুরের নবীনগর সাত মসজিদ হাউজিং চাঁদ উদ্যান এলাকায় বসবাস নিম্নআয়ের মানুষের। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় কারও কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।  আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, মোহাম্মদপুরে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা চার শতাধিক।

আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী আদাবর এলাকায় শতাধিক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তবে আদাবর ১০, ১৬ ও ১৭ নম্বরের বস্তির কোনো বাসিন্দা এই তালিকায় নেই। একই চিত্র ঘনবসতিপূর্ণ সুনিবিড় হাউজিংয়ের।

কল্যাণপুর পোড়া বস্তির বাসিন্দা ইয়াসিন আলি ঢাকাটাইমসকে জানান, এখানে করোনাভাইরাস আক্রান্তের কোনো তথ্য তাদের জানা নেই। আইইডিসিআরের হিসাবে কল্যাণপুর এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ জনের বেশি।

রাজধানীর মহাখালী এলাকায় সাড়ে চার শতাধিক মানুষ করোনা আক্রান্ত। তেজগাঁও এলাকায় আড়াই শতাধিক। কারওয়ান বাজার এলাকায় আক্রান্ত পাওয়া গেছে ২৬ জন। আক্রান্তদের তালিকায় কড়াইল বস্তি, বেগুনবাড়ি বস্তি, তেজগাঁও রেললাইন বস্তি, কারওয়ান বাজারের বস্তির কেউ নেই বলে জানান সেখানকার বাসিন্দারা।

৬৬ দিন সাধারণ ছুটি চলাকালে চালু ছিল রাজধানীর গাবতলী তুরাগ নদের তীরে বালুরঘাট। পণ্যবাহী জাহাজে আসা পাথর, সিমেন্ট, কয়লা, বালু খালাস করেছেন এখানকার শ্রমিকরা। তারা সবাই সুস্থ আছেন। সেখানে কোনো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর তথ্য পাওয়া যায়নি।

গাবতলি সুইপার কলোনিও করোনামুক্ত আছে। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিরাপত্তায় বিশেষ দৃষ্টি দেয় সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোমিনুর রহমান মামুন ঢাকাটাইমসকে জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য নিয়মিত গ্লোবস, মাস্ক, বুট এবং পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ধরনের বিশেষ পোশাক সরবরাহ করা হয়।

তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেশির ভাগই দেখা গেছে কোনো ধরনের নিরাপত্তা পোশাক ছাড়াই কাজ করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্শকর্তারা বলছেন,  এখনো পর্যন্ত তারা সুস্থ থাকলেও সময় এসেছে তাদের বিষয়ে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বনের।

বাংলাদেশে আটকে পড়া উর্দুভাষীদের মোট ১১৬টি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে একাধিক ক্যাম্প আছে। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে দুজন আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন তথ্য জানিয়েছেন ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন আরডিআরএম সভাপতি ওয়াসি আলম বশির।

ঢাকাটাইমসকে আলম বশির আরও জানান, এছাড়া জেনেভা ক্যাম্পের এক শিশু কিডনি রোগ নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখান থেকে সে করোনা আক্রান্ত হয়। পরে তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে মারা যায় ৬ বছরের শিশুটি।

আরডিআরএমের তথ্যমতে, বর্তমানে জেনেভা ক্যাম্প করোনামুক্ত। মিরপুর পল্লবী ও আশপাশের এলাকায় উর্দুভাষীদের ক্যাম্পে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নেই বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা মনে করেন, এখন বস্তিবাসীসহ দেশের সব মানুষকে চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই মহামারি কখন-কোথায় কার মাধ্যমে ঢুকে পড়বে, কত দিন চলবে, কবে থামবে- কেউ জানে না।

নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘কাজেই বস্তিবাসীদের মধ্যে এখন করোনা নাই বলে স্বস্তি প্রকাশের সুযোগ  নেই। আমরা চাই, আমরা যে স্বাস্থ্য সচেতনতা কথা বলি, যে পরামর্শ দেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পরামর্শ দেয়, সেটা তারা মেনে চলুক। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুক। কর্তৃপক্ষকেও নজর রাখতে হবে।’

করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ ও ছড়ানোর প্রথম দিকের প্রক্রিয়া আর বর্তমান সংক্রমণের চিত্র এক নয়। অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘ইতালি থেকে আসা মানুষের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে। তারা কেউ বস্তিতে থাকেন না বা ছিলেন না। তাদের মধ্যে কেউ একেবারে নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যেও নেই। তারা শহর এলাকায় বেশি থেকেছেন, তারা ঢাকায় বেশি থেকেছেন।’

নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনা বহনকারী কোনো ইতালিফেরত যে জায়গাতে অবস্থান করেছেন, সেখানে ভাইরাস ছড়িয়েছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন, তাদের লোকজনরা যে জায়গায় গেছে সেখানে সংক্রমণ হয়েছে।’

পরে সেটা সামাজিক সংক্রমণের ধাপে গেছে। ফলে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন কীভাবে তারা সেটা জানেন না। কেউ বাজারে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এখন বস্তির বাসিন্দাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।’

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম দিকে আক্রান্তের সংখ্যা কম থাকলেও দিনে দিনে তা বেড়ে চলেছে। গত তিন মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। ৬ জুন শনিবার পর্যন্ত মারা গেছে আট শতাধিক।

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কর্মকর্তা জন ক্লেমেনসকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, বাংলাদেশের রাজধানীতে সাড়ে সাত লাখ মানুষ এরই মধ্যে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/০৭জুন/মোআ)