ফরিদপুরে জনতার পুলিশ

বিশেষ প্রতিনিধি, ফরিদপুর
 | প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২০, ২১:০২

‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ফরিদপুর জেলা পুলিশের নানামুখী উদ্ভাবনী জনহিতকর উদ্যোগের মাধ্যমে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আর এসব কাজে যিনি ফ্রন্ট লাইনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তিনি ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান।

গত ২৫ জুলাই ২০১৯ এ যোগদানের পর থেকে এক একটি কাজ করে জেলা পুলিশকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। তার নানামুখী জনকল্যাণমুখী কাজ জেলাবাসীর কাছে এক অভূতপূর্ব উদাহরণের নাম। আর এ কারণেই তিনি জনবান্ধব পুলিশ সুপার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জেলাবাসীর কাছে।

ফরিদপুরে যোগদানের আগে তিনি কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অধীনে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগে ডিসি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সারা পুলিশ বিভাগে অত্যন্ত সৎ, নির্ভীক ও চৌকস অফিসার হিসেবে পরিচিত পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান দেশের জঙ্গি দমনে বিশেষ অবদান রাখেন। আর সে কারণে ২০১৯ সালে তিনি সেবায় বাংলাদেশ পুলিশ মেডেলে ভূষিত হন।

তার হাত ধরে ফরিদপুর পেয়েছে অফুরান বলবান হওয়ার মানসিকতা। গত রোজার ঈদ ও করোনার প্রথম সময় থেকে তিনি নানা উদাহরণ দেখিয়েছেন জেলাবাসীর কাছে।

করোনার প্রথম দিন থেকে শুরু করেন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। বিতরণ করেন মাস্ক, সাবান, লিফলেট। বিদেশফেরত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোম কোরেন্টাইন নিশ্চিত করে প্রশংসিত হয়েছেন। ঘরবন্দি মানুষকে একটু বিনোদন দিতে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে সচেতনতামূলক গান পরিবেশন করেছেন। তার নির্দেশে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলাম হাতে রঙ-তুলি নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান মোড়ে সচেতনতামূলক আল্পনা এঁকেছেন।

নিজেদের দুদিনের বেতন দিয়ে কর্মহীন হতদরিদ্রদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য বিতরণের পর শুরু করেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বাড়ি বাড়ি রাতের আঁধারে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর কাজ।

এরই মাঝে চলে আসে রমজানের ঈদ। সেই ঈদেও তিনি শুরু করেন হতদরিদ্রদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ। এছাড়াও তিনি রোজার পুরো মাস জেলা পুলিশের রিজার্ভ অফিসার আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে শহরের শত শত মানুষের মুখে তুলে দেন সেহরি। এরপর ঈদের দিন তাদের জন্য দেয়া হয় বিশেষ খাবার। শত শত মানুষকে জেলা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা রক্ত দিয়ে গড়েছেন নজির।

আর তার এই কাজ বাস্তবায়নে তার চার সহকর্মী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা, সাইফুজ্জামান, শহিদুল ইসলাম ও সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের সদস্যদের নিয়ে এখনো লড়ে চলছেন পথে-প্রান্তরে।

তারা রাত-দিন পরিশ্রম করে ছুটে চলছেন জেলার এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। তাদের কাজের নিত্য নতুন চমকে জেলাবাসী নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পায়।

গত কদিন আগে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স কাকলী বেগম ঢাকার একটি হাসপাতালে মাসখানেক আগে মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার তিন দিন পরেই মারা যান। এর কদিন পরেই ঈদুল ফিতরের দিনে তার স্বামী মোবারক হোসেনের করোনা ধরা পড়ে। বর্তমানে তিনি আইসোলেশনে রয়েছেন। বৃদ্ধা দাদি এখন দেখাশোনা করছে কাকলী বেগমের নবজাতক শিশুটির। পুরো বাড়িতে চলছে শোকের পাশাপাশি করোনার থাবা। বিষয়টি জানতে পেরে তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ফরিদপুরের পুলিশ প্রশাসন। তাদের সার্বক্ষণিক খবর নিতে পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছেন। তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন উপহার। নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে যেন তারা মনোবল না হারায়।

মোবারক হোসেন বলেন, এসপি স্যারের এই মহানুভবতায় নিদারুণ কষ্টের মাঝেও একটু সান্তনা পেয়েছি। আশার আলো দেখছি।

শুধু মোবারক হোসেনের পরিবারেই নয়, সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ফরিদপুরের পুলিশ প্রশাসনের গৃহিত নানা মানবিক কার্যক্রম অসংখ্য অসহায় পরিবারে স্বস্তি এনেছে।

জেল পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর পুলিশ সদস্যদের বেতন থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ফরিদপুরের অসংখ্য অসহায় পরিবারে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপারের আহবানে জেলা পুলিশের ১৫৫০ জন সদস্যের বেতনের টাকার একটি অংশ মানবিক সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে যুক্ত হচ্ছে এই তহবিলে। স্বেচ্ছায় সবাই এগিয়ে আসেন এই কাজে।

জেলা পুলিশের পক্ষ হতে অসহায় মানুষের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুজ্জামানকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে একটি ত্রাণ বিতরণ কমিটি। চালু করা হয় হটলাইন। অসহায় মানুষের ফোন পেলেই পুলিশের রিজার্ভ অফিসার এসআই আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে পৌঁছে দেয়া হয় খাবারসামগ্রী। যেই পুলিশ অফিসে একসময় ভুক্তভোগীরা যেত আইনি সহায়তায়, সেখানে এখন ত্রাণের জন্য অসহায় মানুষের দীর্ঘ সারি।

‘প্রয়োজনীয় কাপড়টি নিয়ে যান, অব্যবহৃত কাপড়টি রেখে যান’ স্লোগানে ফরিদপুর পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামানের নির্দেশনায় আর্তমানবতার সেবায় অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে ফরিদপুর জেলা পুলিশ। যেখানে যে কেউ পারেন নিজের অব্যবহৃত কাপড়টি এখানে রেখে আর্তমানবতার সেবায় অংশগ্রহণ করতে।

গত ৩১ মে রবিবার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ চক্রবর্তী মারা যান।

মৃত্যুর পর তার সৎকারে কেউ এগিয়ে আসেনি। এরপর মরদেহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে অম্বিকাপুর শ্মশানঘাটে নেওয়ার সময় এলাকার লোকজন রাস্তায় বাঁশ দিয়ে বাধা দেয়। তখন ফরিদপুর জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেলের রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে ওসি কোতয়ালি ও অন্য সঙ্গীয় ফোর্সসহ অম্বিকাপুর এলাকার লোকজনদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে বাঁশ সরিয়ে মরদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যায়।

শ্মশানঘাটে মরদেহ দাহ করার লোকজন না পাওয়ায় ফরিদপুর জেলা পুলিশের কুইক রেসপন্স দলের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন ও সঙ্গীয় ফোর্সসহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ নামিয়ে শ্মশানঘাটে রাখেন এবং চিতা সাজানোর জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল রাশেদুল ইসলাম নিজেই কাঠ সংগ্রহ করেন এবং নিজের হাতে চিতা সাজান।

তার সন্তানদের শ্মশানঘাটের রেজিস্ট্রার লিপিবদ্ধ করতে বললে রাজি না হওয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সদর সার্কেল রাশেদুল ইসলাম অভিভাবকের কলাম নম্বরে স্বাক্ষর করেন এবং পুলিশ নিজেই মরদেহ দাহর সব কাজ সম্পন্ন করেন- যা এক অনন্য নজির গড়েছে ফরিদপুর জেলা পুলিশ।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-এর সভাপতি শিপ্রা গোস্বামী বলেন, করোনাকালের শুরু হতেই ফরিদপুরের পুলিশ বিভাগের নানা কার্যক্রম শুধু জনসাধারণের নজরই কাড়েনি, তাদের মাঝে আশার আলো ছড়িয়েছে।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলাম বলেন, ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান চৌকস নেতৃত্ব ও আন্তরিকতার কারণেই আমরা এই দুর্যোগকালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। তার আহ্বানে সব পুলিশ সদস্য বেতনের একটি অংশ ত্রাণ তহবিলে দিচ্ছেন।

পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান বলেন, সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি পুলিশ সদস্যদের জানানোর পরে তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের বেতনের একটি অংশ দিয়ে কর্মহীনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা এই সমাজেরই অংশ। করোনাকালে সাধারণ মানুষের জন্য পুলিশ সদস্যরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেজন্য সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

ফরিদপুর পুলিশ বাহিনী আইন দিয়ে নয়, ভালবাসা দিয়ে তারা আজ ফরিদপুরবাসীর অন্তরের অন্তস্থলে গেঁথে গেছেন বলে মনে করেন এই জেলার বাসিন্দারা। আর সেই সাথে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে পুলিশকে জনতার সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

(ঢাকাটাইমস/১১জুন/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :