করোনাকালে ‘শহুরে প্রবাসীর’ বেঁচে থাকার গল্প

এবিসি জাবের
 | প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২০, ২১:১৪

বাবার ভাষায় গণ্ডগোলের ঠিক পরপরই ঢাকায় এসেছেন তিনি রুটি রুজির সন্ধানে। তার কদিন আগেই দাদা মারা গেছেন। আমার বাবা তখন যদিও ছোট মানে সবেমাত্র প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার হবেন। কিন্তু দাদার আরও এতিম সন্তান এবং সদ্যবিবাহিতা বড়বোন ও মায়ের দেখাশোনার ভার বাবাকেই নিতে হলো। তখনকার সময়ে এক টাকা রোজে কাজ করতেন। সংগ্রামের শুরু তখনই। দাদার সাথে ক্ষেত-খামারে সহায়তা করতেন কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই নতুন দেশের গড়ে উঠার সারথি হলেন নিজের পরিবারকে টেনে তুলে টিকে থাকার মানসে। খুবই সাধরণ একজন মানুষ বাবা কিন্তু অসাধারণ তার জীবন প্রবাহ এবং জীবনের গতি প্রকৃতি। একে তো শিশু তার ওপর পরিবারের দায়িত্বভার কাঁধে। আজও পথে ঘাটে এমন অনেক শিশু-কিশোর দেখি যে হয়তো তার বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা মায়ের ভরণপোষণের জন্য শহরে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটা মানুষের গল্পই ভিন্ন ভিন্ন এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক বিস্তর।

স্কুলে পড়ার খুব ইচ্ছা থাকলেও আর পড়া হয়ে উঠেনি বাবার। পাড়ি জমিয়েছেন শহরে। সেই যে শহরে আগমন আজও সেই অর্থে গ্রামে ফিরতে পারেননি। প্রবাসীদের মতো কালেভদ্রে যান আর আজ তো অনেকদিন হলো যাওয়া হয় না। একজন পুরোদস্তুর শহুরে প্রবাসী বলা চলে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। প্রায়ই একটা শ্লোক বলেন বাবা- ‘যদিও পড়ে কহর, তবুও ছাড়িও না শহর’। করোনাকাল চলছে। কহর তো পড়েই গেল। আমরা শহুরে প্রবাসীরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।

লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই আমরা ঘরে। আমার বাবা, মা, ছোট ভাই, আমি, আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী এবং আরও কিছু আত্মীয় সবেমাত্র বাসায় এসে উঠেছেন। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ক্যাটাগরির একটা হস্তশিল্প তথা বাঁশের তৈরি পর্দার ব্যবসা আমাদের। খুবই ছোট একটা কারবার। তবে এই কারবারের মাধ্যমেই আমাদের আজ এ অবধি আসা হয়েছে তাই ছোট হলেও সেটা তুচ্ছ নয়। আমরা দু ভাই কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি এবং সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গিয়েছি। খুব বেশিদিন হয়নি নিজ থেকে কিছু করার মানসে উদ্যোগ নিয়েছি। কর্মজীবনে সমাজকর্ম, সাংবাদিকতা আর ছোট খাটো ব্যবসা থেকে বছরখানেক হয় বিরতিতে আছি, একেবারে প্রচলিত অর্থে বেকার নয়।

লকডাউন শুরুর মাসেই আইটি ব্যবসার উদ্দেশে ছোট একটা কারবার শুরু করলাম, অফিস নিলাম বন্ধুদের সাথে। কে জানতো লকডাউন এইভাবে নামবে আর এমন অবস্থায় যাবে দেশের পরিস্থিতি!

বিনা বেতনে হস্তশিল্পের শিল্পীদের গ্রামে পাঠাতে হলো। অফিস, কারখানা আর বাসা ভাড়া জমা শুরু হলো। এদিকে স্মরণকালের একটা বড় সম্ভাবনাময় অর্ডার চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যান্সেল হয়ে গেল আরও কিছু লোকাল ও খুচরা অর্ডার স্থগিত। লকডাউনের শুরু থেকেই ক্যাশলেস লাইফ। দীর্ঘদিন বাবা-মা অসুস্থতায় ভুগছেন। ছোটভাই পারিবারিক কারবার দেখলেও প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে গাড়ি চলে তো চলে না গোছের গতিময়তা নিয়ে টিকে থাকছে ব্যবসায়। পড়াশোনায় আমাদের লম্বা সময় পার হওয়ার কারণে এই হস্তশিল্পের কারবার নিয়ে তেমন একটা সম্পৃক্ততা হয়ে উঠে নাই। আমি ছাত্র সময় থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং লেখালেখি সংক্রান্ত কাজে জড়িয়ে থাকায় সেদিকে ক্যারিয়ারের ভাবনায় ব্যস্ত ছিলাম। সময়ের চাহিদায় ব্যবসার পথে নেমেছি বেশিদিন হয় নাই। শারীরিকভাবে অসুস্থ বাবার ঘরবন্দি হওয়ার সময় বছরখানেক হলো। গঠনমূলক ও গোছানো ব্যবসা না হওয়ায় বাবার ওপরই পুরো কারবার নির্ভরশীল ছিল। কাঁচামাল তৈরি থেকে কাস্টমার খোঁজাখুঁজি। ইতোমধ্যে, চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যয়ে সঞ্চয় সব শেষ। গঠনমূলক কারবার না হওয়ায় লোন ইত্যাদিও সহজলভ্য নয়। সংগ্রামরত মধ্যবিত্ত পরিবারে অসুস্থতা এক প্রকার অভিশাপ।

লকডাউনে আমরা সবাই ঘরবন্দি। এরই মাঝে এতগুলো মানুষের খাবারের জোগান তার ওপর সপ্তাহান্তে ওষুধের খরচ, বেশ ব্যয়বহুল অবস্থা। খেয়ে না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ওষুধের অভাবে বাবা-মাকে অসুস্থ দেখা যায় না। এদিকে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা মাথায় যা সময় সময় চিকিৎসা ইত্যাদির সূত্রে নেওয়া হয়েছে। তাই ঋণ চাওয়ার দরজাও প্রায় বন্ধ। আবার সবার কাছে তো আর ঋণ চাওয়া যায় না। তার ওপর নগদ-কিস্তিতে বাবা শহরের প্রান্তে ছোট একটা জমির মালিকানা সদ্যই বুঝে পেয়ছেন। আত্মীয় স্বজন অনেকেই জানে যে আমরা এখন জমিদার।

সুধারণা ভালো আর দোয়াও করি তাদের আশা পূর্ণ হোক। সুতরাং সাহায্য আর সহায়তা চাওয়ার জায়গা তেমন আর নাই। বছরখানেক আগেই মাত্র একটু ভালো আবাসনে এসে উঠেছি আমরা। একদা আড়াই’শ বর্গফুটের বাসা ছেড়ে এখন প্রায় আঠারো’শ বর্গফুটের বাসা।

প্রতিবেশীরা প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত ঘরানার। বাড়িওয়ালাও একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও ব্যাংকিং জগতের অগ্রগামী মানুষ। মোটামুটি ভালো পরিবেশ আমাদের বাড়িতে। এলাকাটা উন্নয়নশীল হওয়ায় আশেপাশে বাড়ি নির্মাণের কাজ লকডাউনেও চলছে। আমাদের বাড়ির মেরামতও বন্ধ ছিল না শুরুর দিকে। এলাকার অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা একটু বেশিই বলা যায় তুলনামূলকভাবে। আমাদের বাসার লাইনে সবটাই টিনশেড কেবল একটামাত্র বাড়ি। তাই এই টিনশেডের মানুষদের কষ্ট লাঘবের একটা ফিকির ছিল শুরু থেকেই কিন্তু কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেননা, এমন একটা অবস্থা যে নিজেরাই বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছি। আমার মা, একজন পুরদস্তুর সমাজসেবী না হলেও কোন অংশে কম না। প্রতিবেশী এবং এলাকার দরিদ্র মানুষের সাথে তার উঠাবসা। আমার বাবারও এই একটা অভ্যাস। আমার ভালো লাগে এবং কমবেশ নিজেও এই বিষয়টা বজায় রাখতে চাই যে অন্তত আমাকে এলাকার অভাবী ও বিপদগ্রস্ত মানুষটা আপন ভাবুক।

লকডাউনের শুরুর দিকে এক সকালে দরজা খুলতেই কিছু মহিলাকে দেখলাম আমাদের দরজায় বসে আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস অরলে তারা জানালো তাদের অভাবের কথা। তারা নাকি শুনেছে এ বাসা থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। বাসায় এসে জানা গেলো আম্মু ঘরে রক্ষিত খাবার থেকে কিছু খাবার সামাগ্রী বিশেষ করে চাল দিয়ে সহায়তা দিয়েছেন। ব্যাপারটা জেনে আপনে বাঁচলে বাপের নাম ধরনের অবস্থার প্রেক্ষিতে রাগ হতে গিয়েও আর হলাম না। আনন্দই লাগলো এই মানবিকতা দেখে। কিন্তু কদিন পর নিজেদেরই যে এমন ত্রাণ চাওয়ার অবস্থা হবে জানা ছিল না। শহরে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরানার মানুষজন কত দিনের খাবারই বা মজুদ করে আর লকডাউনের শুরুতে বাজার সদাই করে ঘরে ঢোকার মতো এমন প্রশ্নবিদ্ধ কর্ম করার মতো নগদ অর্থ ছিল না তাই সেটাও আর হয়ে উঠে নাই। অগত্যা বাধ্য হয়ে এদিক সেদিক যত জায়গায় সম্ভব ছিল লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে নক দিলাম। কমবেশ আমার বাইরের জানাশোনা বাসার অন্য যে কারও চেয়ে একটু বেশি থাকায় এই লকডাউনে পুরো বাসার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই উঠল। স্থানীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কোনোটাই বাদ দিইনি সম্ভাব্য এবং যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে অন্তত। একটা বিষয় আমি শুরু থেকেই করার চেষ্টা ছিল সেটা হলো, যখনই কোনো জায়গায় সহায়তার আবেদন করেছি সেখানে কেবল আমাদের পরিবারের জন্যই করিনি। বরং এলাকার কিছু না চাইতে পারা মধ্যবিত্ত এবং কাছের আত্মীয় স্বজনদের জন্যও করেছি। অবশেষে অনেক নিরাশার মধ্যে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সাধ্যানুসারে এগিয়ে এসেছে। কেউ খাবার সামগ্রী আর কেউ অর্থ সহায়তা। কখনও ভাবিনি যে লাইনে দাঁড়িয়ে কোনোদিন রিলিফ নিতে হবে। আল্লাহর লীলা বোঝা বড় দায়। ছেলেবেলা থেকে উচ্চবিত্তের স্বপ্নদ্রষ্টা বাবা আমাদের পড়াশোনা এবং দেখভাল সেই স্ট্যান্ডার্ডে করেছেন। বন্ধুবান্ধব আর সার্কেল পেয়েছি ধনী আর শিক্ষিত শ্রেণির। আমাদের জীবনযাপন আর চিন্তা-চেতনার ধরনেও একটা পরিশীলিত ভাব বরাবরই বজায় থেকেছে। এমতাবস্থায় এমন এক সংকটে নিজেদের অপারগতা যতটা না বাহ্যিক তার চেয়ে ঢের বেশি মানসিক। তবুও বাঁচতে হবে এটাই মূল কথা।

রমজান মাস এলো। বাড়ির অনেকেই ত্রাণ বিতরণ করেছেন। বিশেষ করে বাড়ির মালিক। আশেপাশে অনেক ঘর। আমরা ঠিক তার উপর তলায় থাকি। তার ভাবনাতেও আসেনি। আমিও তাকে আর বলিনি। বাহির থেকে জোগাড় করেছি কিন্তু মনটা চাইছিল বলি একবার কিন্তু পরক্ষণে আর বলিনি। তারাবি পড়ালাম বাড়ির বেজমেন্টে। লকডাউনের শুরু থেকে ধর্মের সাজেশন অনুসারে ঘরেই থেকেছি। নামাজ রোজা সবটাই ঘরে। অপরিণামদর্শী আবেগি মানুষদের আলাপে কান দিইনি এবং পরিবারকেও বুঝিয়েছি। কিন্তু আমাদের ধর্ম ইসলামের বয়ান নিয়ে কত কী যে হলো এই করোনাকালে! আফসোস!

করোনার এই সময়টায় আমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী এবং আমার স্ত্রীর বিবাহপরবর্তী প্রথম জন্মদিন। তারুণ্যের দাবি হলো এই সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মানুষ কত কিছু করে। বেচারির কপাল আর আমার ভাগ্য। সাদামাটাভাবে সুদিনের অপেক্ষায় এই ত্যাগ মেনে নিলো স্ত্রী। বলল একদিন সব হবে ইনশাআল্লাহ। কষ্ট লাগছিল মনে তবুও পরিস্থিতির কাছে আমরা অসহায়।

লকডাউন উঠে যাচ্ছে। পৃথিবীর মেরামত চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য আসমান থেকে দুঃখ প্রকাশ করছে যেন। পরিবেশ ও জলবায়ুর এমন উন্নতি এবং সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের এমন একটা পুনর্গঠন দরকার ছিল বটে। সংকটকাল কাটেনি সাময়িকভাবে আমরা বাঁচার তাগিদে ঘর থেকে বের হবো অথচ সচেতনতা তেমন নাই। আর না এই দূষণমুক্ত পরিবেশকে বহাল রাখতে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। আমাদের শিক্ষার লেবেল না বাড়ানো গেলে আমাদের দুর্ভোগ কমবে না। কদিন বাদে হয়তো আমাদের অবস্থা অবনতির দিকে দেখবো অথবা দেখবো না কিন্তু দূষণের নগরী থেকে আর বৈষম্যের সমাজ থেকে মুক্তি মিলবে তো?

করোনাকালে বাবা-মাকে কাছে থেকে দেখেছি। তাদের সেবা শুশ্রূষার সুযোগ হয়েছে কিন্তু শহুরে প্রবাসী হওয়ার কারণে এক ভিন্ন ধরনের সংকট দেখেছি যা আগে কখনই ভাবিনি। নবীজি সা. এর একটি বাণীর সত্যতা পেয়েছি যেখানে তিনি বলেছেন যে, যদি তোমার কাছে কেউ উটে আরোহণ করে কিছু চায় তাকে দিও! আমাদের ক্লাসে এর ব্যাখ্যায় হুজুর বলতেন সে যুগের উট মানে এই যুগের প্রাডো, মার্সিডিজ আর অডি ধরনের যানবাহন। বৈষয়িকভাবে বেশ কিছু জিনিস আছে আর একটা স্বাভাবিক ছন্দময় জীবন যাপনও আছে কিন্তু লকডাউনের সময় কোনো সঞ্চয় নেই। এদিকে বাবা-মা অসুস্থ। মেডিক্যাল খরচ আর টেস্ট ইত্যাদির রিকোয়ারমেন্ট এসেছে ডাক্তার থেকে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে কিন্তু আমরা সুদিনের অপেক্ষায়।

ভিডিও কলের মাধ্যমে যখন গ্রামের আত্মীয়দের সাথে আলাপ করছিলাম তখন সত্যি প্রবাস প্রবাস অনুভূতি হয়েছিল। কতজনের বিয়ে হলো আর কতজনের ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেল। আমরা জীবন সংগ্রাম ও শহরে একটু দাঁড়ানোর মানসে নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। সময়টা কেটে যাবে আশাকরি। জীবিত থাকলে এই নাড়ির টানে জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখি।

লেখক: সমাজকর্মী ও উদ্যোক্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :