কাইউম স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা

ড. সৌমিত্র শেখর
 | প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০২০, ১২:৩৯

আজ একটু বেশি ভোরেই জেগে গিয়েছিলাম; পাঁচটারও আগে। আপাতত ঘুম আসবে না জেনেই ‘পড়ার ঘরে’র আলো জ্বালালাম। বুকসেল্ফে হাতে দিতেই উঠে এলো মোহাম্মদ আবদুল কাইউম রচিত ‘রবীন্দ্রনাথ : সমকালে পত্রিকায়’ গ্রন্থটি। পৃষ্ঠা উল্টাতেই ভেসে এলো ‘সৌমিত্র শেখর, কল্যাণীয়েষু’ লিখে লেখকের স্বাক্ষর। তারিখটা একটু আগের: ২০১৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর।

‘লেখকের স্বাক্ষর’ বলছি কেন, তিনি আমার ‘স্যার’ ক্লাসে পাঠ নিয়েছি তাঁর কাছে। তাই তিনিও স্নেহবশতই আমাকে ‘কল্যাণীয়েষু’ লিখেছেন। স্বল্প-পরিচিত বা অপরিচিতরা এভাবে লিখবেন না। প্রাগুক্ত নামেই এক, দুই, তিন বলে তিনটি বই তাঁর। প্রতিটি সব মিলিয়ে ৮০ পৃষ্ঠার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষে (২০১১) ঢাকার মূর্ধন্য প্রকাশনীর প্রকল্পের জন্য লেখা।

আমার কাজের প্রয়োজনীয়তা মেটাবার উপাদান কতোটুকু আছে, তা ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণ করছিলাম আর মনে করছিলাম স্যারকে: আহা, কতো দিন হলো, স্যারকে দেখি না। আগেতো হুটহাট করেই হাতিরপুল মোড়ের ‘লা ভিস্তা’ ফ্ল্যাটে চলে যেতাম। এখন ফ্ল্যাট বদলের কারণে তা হয়েও ওঠে না। না-জানি কেমন আছেন স্যার! দিনের ব্রহ্মমুহূর্তে হঠাৎই মনে পড়লো স্যারকে।

ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে আবার একটু ঘুমোতে গেলাম। উঠেই স্যারের ‘বৈবাহিক’ বিশিষ্ট সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদুর ফোন: ‘কাইউম সাহেব নেই; ভোর ৬টায় চলে গেছেন।’ এ-ব্যাপারে বেশি কথা বলার তাঁর দরকার হলো না; কারণ, সপ্তাহখানেক আগেই স্যারের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। তারপরও সংবাদটি সত্যি নাকি স্বপ্ন আঁচ করতে আমার খানিকটা সময়ই লেগেছিল।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ছিলেন ভারত-ভাগোত্তর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এদেশের একজন অন্যতম কারিগর। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি, ঢাকার রহমতগঞ্জে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুশেন ও ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক (১৯৫৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৪) ডিগ্রি নেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘হ্যালহেড থেকে হাউসটনের ব্যাকরণ’ নিয়ে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মসূত্রে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে তাঁর অবসরগ্রহণ।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউমের জীবনটি শুধু পড়ানো আর ঘরেফেরাকেন্দ্রিক ছিল না। কারণ তিনি শুধু অধ্যাপকই ছিলেন না, ছিলেন জাত-গবেষক এবং মুসলিম জীবনদর্শন সুপ্রকাশ্যে আনার একনিষ্ঠ কর্মী। এটি তিনি পেয়েছিলেন পিতা মোহাম্মদ কাসেমের কাছ থেকেই। তাঁর পিতা জীবিকানির্বাহের জন্য কঠোর কায়িক শ্রম দিয়েছেন বটে, কিন্তু তখনই ‘অভিযান’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র সঙ্গে যুক্ত হন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘অভিযান’-এ লিখেছেন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম পিতার সেই ধারাবাহিকতাতেই গবেষণা করেছেন এবং ‘মুহম্মদ এনামুল হক’ (জীবনী), ‘খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ’ (জীবনী), ‘কাজী ইমদাদুল হক’ (জীবনী); ‘আর্জুমন্দ আলীর প্রেমদর্পণ’ (সম্পাদনা), ‘মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচনাবলি’ (সম্পাদনা); ‘সাময়িকপত্রে সাহিত্যিক প্রসঙ্গ’ (সংকলন), ‘আলাওল রচিত সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী (সম্পাদনা), ‘মীর মশাররফ হোসেন ও শতবর্ষে বিষাদ-সিন্ধু’ (সংগ্রহ),‘আলাওল রচনাবলি’ (সম্পাদনা), ‘চকবাজারের কেতাবপট্টি’, ‘রতœবতী থেকে অগ্নি-বীণা : সমকালের দর্পণে’ (সংগ্রহ), ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’, ‘নজরুল-সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ ইত্যাদি গ্রন্থ জাতিকে উপহার দিয়েছেন।

উল্লিখিত সবগুলো গ্রন্থেই মুসলিম সাহিত্যিকদের জীবন ও রচনাসম্পর্কিত বিষয়কে মুখ্য করে তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকা থেকে হারিয়ে যেতে পারে এমন মুসলিম-প্রসঙ্গ এযুগের পাঠকদের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সংকলন করেছেন। তবে, তিনি ১৯৭০ সালে ‘পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ-সমালোচনা’ গ্রন্থ লিখেই আগ্রহীদের আলোচনায় নিজের স্থান করে নেন। বইটি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠের ক্ষেত্রে পদ্ধতিবিদ্যা পরিচয়ের একেবারে প্রাথমিক ও অবশ্যপাঠ্য বই হিসেবে এখনো বিবেচিত হয়।

এছাড়াও মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ব্যাকরণ, অভিধান ও বানান বিষয়ে নানা সংসর্গে কাজ করেছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। যেমন: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গবেষণা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, দেওয়ান আবদুল হামিদ পুরস্কার, কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশ পুরস্কার ইত্যাদি। আমি মোহাম্মদ আবদুল কাইউমকে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না, কিন্তু তীক্ষè ছিল তাঁর দৃষ্টি। বসতেন আমাদের অপর শিক্ষক মোহাম্মদ ফারুকের বসবার পরের কক্ষে; কিন্তু তাঁর কক্ষে যেতে হতো মোহাম্মদ ফারুকের কক্ষের ভেতর দিয়ে।

আপাত রসকষহীন বিষয় তিনি আমাদের পড়াতেন। ভাষার ইতিহাস, পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ-সমালোচনা আমি তাঁর কাছেই পড়েছি। মুসলিম সাহিত্যিকদের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ থাকলেও নজরুলের ওপর তাঁর লেখালেখি অনেক পরে শুরু হয়েছে। বইতো বের হয়েছে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে (‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’)। কিন্তু তিনি ১৯৮৯ সালেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল-অধ্যাপক হয়েছিলেন। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। কারণ, আমাদের স্যার ছিলেন সৈয়দ আলী আহসানের ছাত্র এবং পিতার সূত্রেও তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমরা এসব জেনেছি অনেক পরে।

জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা যখন ছাত্র-আন্দোলন করছিলাম, তখন এরশাদের পক্ষাবলম্বনকারী ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে আমাদের স্যারের ঘনিষ্ঠতায় খুব পীড়িত হতাম। তাঁর ছাত্র থাকাকালে স্যারের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সাধারণ সম্পর্কের বাইরে আমার তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। শ্রদ্ধা আর বরং একটু দূরত্বই ছিল। স্যারের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় দফায় দেখার পর ঘনিষ্ঠতা জন্মে। মধ্যবর্তী সময় ছয় বছর। এম. এ. পাশের শেষে কলকাতায় পিএইচ. ডি. করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদানের পর স্যারের স্ত্রী অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানার সহকর্মী হই।

মিরপুর থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই মাইক্রোবাসে আসা-যাওয়া করেছি। মিরপুরে স্যারের ‘সঞ্চিতা’ নামে বাড়ি ছিল। ছাত্রজীবনে বিভাগের কোনো কাজে সেই বাড়িতে একবার যাবার সুযোগ হয়েছে। বসবার ঘরটা যেন হাজার বইয়ের লাইব্রেরি বানিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। পরে বাড়িটি বিক্রি করে যখন হাতিরপুলে ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন, তখন বেশ কয়েকবার সেই বাসায় আমার যাওয়া হয়। এসময় স্যার আমার ওপর আস্থা রাখতেন। অনেক গোপনীয় রিপোর্ট বা লেখার দ্বিতীয় সাক্ষী ছিলাম আমি।

প্রথম সাক্ষী অবশ্যই তাঁর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা । রাজিয়া আপার সরলতা নিয়ে অনেককে হাসাহাসি করতে দেখেছি। স্যার কিন্তু স্ত্রীকে নিয়ে গর্বের সঙ্গেই চলতেন। ছাত্র থাকাকালেও দেখেছি, কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। পরেও দেখেছি, সেই ধারা আরো শক্ত হতে। আর রাজিয়া আপাতো হাসতে হাসতে বলতেই, ‘কাইউম সাহেব’ই তাঁকে গড়েপিটে ‘মানুষ’ করেছেন। আজ এই যুগলবন্দির তান ছিন্ন হলো। পারিবারিকভাবেও অত্যন্ত সচেতন ও হিসেবি পথে চলেছেন আমার এই স্যার। আমার জানা মতে, সবই গুছিয়ে রেখে গেছেন তিনি। সন্তান ও ছাত্রদের প্রতি স্নেহ ও কর্তব্যে তিনি ছিলেন অবারিত ও পরায়ণপর।

আজই বিকেল ৪টা নাগাদ লালবাগে তাঁর পিতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন এই শিক্ষক। আমি আমার এই প্রয়াত শিক্ষককে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়!

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকাটাইমস/১৩জুন/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :