আমার মায়ের কথা
আমাদের বাসায় ছিল বিশাল সাইজের একটা বইয়ের আলমারি, ডাইনিং স্পেসের দেয়ালজুড়ে, এ মাথা ও মাথা। আর শেলফ ভর্তি রাজ্যের বই। সত্তুরের দশকের শেষ ভাগে, আশির দশকের গোড়ার দিকে আমাদের টিনের ঘরটি ভেঙে যখন বিল্ডিংটা তৈরি হচ্ছে, তখনই দেয়ালের মাপ নিয়ে এটা বানানো হয়।
আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড় বোন একটা খেলা আবিষ্কার করলাম। শেলফ থেকে যে কোন একটা বইয়ের নাম বলতাম একজন, অন্যজনকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বইটা খুঁজে বের করতে হতো। এই খেলা খেলতে গিয়ে অজান্তেই রাজ্যের বই আর লেখকের নাম মুখস্ত হয়ে গেল।
নিজেদের প্রেস ছিল, সেই সুযোগে প্রতি বছর বিচিত্রা, সন্ধানীসহ সব ঈদ সংখ্যাগুলো একসাথে বাঁধাই করে রাখা হতো, সেগুলোর সাহিত্যমূল্যও কম ছিল না। তখনো দৈনিক পত্রিকাগুলোর ঈদ সংখ্যা প্রকাশের রেওয়াজ চালু হয়নি। পুরো বাসায় বই পড়ার একটা দারুণ আবহ ছিল। প্রতিবার বইমেলা উপলক্ষে বড় আপা সিলেট মেডিকেল কলেজ আর মেজো আপা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে চলে আসতেন। সারা বছর তারা স্কলারশিপের টাকা বাঁচিয়ে রাখতেন, এই সময়টার জন্য, বই কিনতে।
আশপাশে তখন দেখতাম 'আউট বই' পড়াকে চরম গর্হিত অপরাধ মনে করতো অভিভাবকরা। আমাদের বাসায় উল্টা দৃশ্য। বড় ভাইবোনতো বটেই, আব্বা-আম্মাও যে কোনো উপলক্ষে হাতে তুলে দিয়েছেন বই।
এই প্রাক্টিসের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল আমার আম্মা, কবি, উপন্যাসিক ও গল্পকার মেহেরুন নাহার চৌধুরীর।
আম্মার ছিল বই পড়ার দুর্দান্ত নেশা। প্রতিদিন খাওয়ার পর একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়তেন। তো একবার হয়েছে কী, দুপুরে শোবার সময় আম্মা আবিষ্কার করলেন এক একদিন বিছানায় বিচিত্র সব বইয়ের সমাহার। কোনোদিন আমার জ্যামিতি বই, তো আরেক দিন বড় আপার মেডিকেলের ঢাউস কোনো বই। কে এনে রাখছে এসব! পরে আবিষ্কার হলো, আম্মার প্রতিদিনের বই পড়ার অভ্যাস দেখে, তার সুবিধার জন্য বাসার মেয়েটা বিছানায় 'বই' দিয়ে রাখে, তার ধারণা, পড়ার জন্যতো একটা বই হলেই হল!
আম্মা লিখতেন। তার লেখা গল্প-কবিতা সাপ্তাহিক পূর্ণিমাসহ সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতো নিয়মিত (এখন সব পত্রিকার নাম মনে করতে পারছি না)। আমরা জানতেও পারতাম না, কখন লেখাগুলো লিখে, নিজ হাতে কপি করে বাসার দারোয়ান বা আমাদের প্রেস কিংবা রাবার ফ্যাক্টরির কোনো কর্মচারিকে দিয়ে পোস্ট করাতেন, যথা সময়ে ডাকযোগে এসে পৌঁছাতো লেখক সংখ্যা। আমরা অবাক হতাম, খুশি হতাম তবে আম্মার এসব কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সমঝদার এবং পেট্রন ছিলেন আব্বা, আব্দুল কাইয়ুম ভুইয়া। আম্মার লেখালেখিতে তার উৎসাহ ছিল দেখার মত।
নিজেদের প্রেস থাকা সত্ত্বেও আম্মা কখনো নিজের উদ্যোগে, নিজ খরচে বই প্রকাশের পক্ষে ছিলেন না। সময় প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ফরিদ ভাই শুধু মেজো ভাইয়ের বন্ধুই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তার উদ্যোগে সময় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় আম্মার একমাত্র উপন্যাস ‘নির্মোহ’। বইটি উৎসর্গ করেছেন আব্বাকে, যার প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া তার সাহিত্যচর্চা ছিল অসম্ভব।
আজ আমার আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী। আমার আম্মা অত্যন্ত আধুনিক ছিলেন, ছিলেন খুব পরহেজগার। কখনো কারো মনে কষ্ট দেননি, অত্যন্ত উদার মনের ছিলেন তিনি। আল্লাহ তাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান কবুল করুন। আমীন।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক