আমার পিতা: দ্রোহ ও দর্শনে অসামান্য ব্যক্তিত্ব

শাহান সাহাবুদ্দিন
 | প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২০, ১৭:০০

আমার মহান পিতা তিনি। জনাব আব্দুল বাছেদ মিঞা। বিপন্ন মানুষের জন্য নিবেদিত জীবন, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করা যে চরিত্রগুলো আমি বই ঘেঁটে জেনেছি, তারও আগে সেই শৈশব থেকে বইয়ের বাইরে ‘লড়াকু মানুষ’ বলতে আমার বাবাকেই প্রথম দেখি আমি। যিনি সুকান্তের ‘প্রিতমাসু’ কবিতার যেন সেই বাতিওয়ালা, যিনি সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরেন, অথচ নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।

আমার ভাবতে ভালো লাগে যে আমার বাবা নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবেন নি। আমার চোখের সামনে কতো লড়াই করতে দেখেছি আমার বাবাকে বিপন্ন মানুষের জন্য, অসহায়ের জন্য। সে সমস্ত লড়াই ছিলো অসম, বলতে গেলে একাই লড়ে গেছেন তিনি। অধিকাংশ লড়াই ছিলো রাঘব বোয়াল বা প্রশাসনের ঘুষখোর অসৎকর্তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এই লড়াইগুলো ছিলো কোনো কৃষক বা শ্রমিক বা সব হারানো মানুষের জন্য।

অথচ বাবা কিন্তু কখনোই লেনিন বা কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বের শৃঙ্খলিত পথে হাঁটেন নি। তিনি কাউকে নেতাজ্ঞানে পুজোও দিতে যান নি। কোনো নেতার রেফারেন্সে লড়াই বা বিপ্লবের মাঠে অবতীর্ণ হননি। এখন বুঝতে পারি, লড়াইয়ের জন্য তাঁর মূল পুঁজি ছিলো সাহস ও চেতনা। আমার বাবাকে যারা তারুণ্যের অমিতাভ দিনগুলোয় দেখেছেন তারা জানেন কতোটা শক্তি ছিলো তাঁর বজ্রনিনাদ কন্ঠ ও দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশীতে।

কাবাডি ও দারিয়াবাধার মাঠে তিনি ও আমার বড় চাচা ডাক্তার আবু তাহের (তারা ডাক্তার) ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এই প্রতিভা তাঁরা আমার দাদার উত্তরসূরি হিসেবে পেয়েছিলেন। বিষয়টা যতোটা না তৈরি হওয়া, তারচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে জিন বা রক্তের শানিত প্রবাহ, এরকমটি-ই মনে করি আমি। এখনো সেইসময়ের মানুষদের মুখে মুখে দু’ভাইয়ের কিংবদন্তির কথা শুনে আলোড়িত হই। লোমকূপ জেগে ওঠে। সালিশ বা দরবার-এ বাবার প্রজ্ঞার ঝলকের কথা লোকমুখে শুনেছি, নিজেও কিছু প্রত্যক্ষ করেছি।

আমার বাবার বয়স এখন সত্তুরের কাছাকাছি। আজও আমি বুঝে পাইনা প্রথাগত বিপ্লবের পথে না হেঁটে শুধুমাত্র মানুষের জন্য একটা জীবন বাজি ধরার সাহস তিনি পেয়েছিলেন কোথায়! মানবীয় সীমাবদ্ধতা তাঁর নিশ্চয়ই ছিল, আছে। কিন্তু এগুলো ছাপিয়ে তিনি অনন্য মানুষ হয়ে আমার কাছে ধরা দেন তাঁর লড়াকু কর্মযজ্ঞের কারণে। ইস্পাত দৃঢ় কঠিন মানসিকতার এই মানুষটিকেই আমি আবিষ্কার করলাম একেবারেই অন্য মানুষ হিসেবে ১৯৯৯ এর এক রাত্রিতে। তিনি ঘরে ফিরে কী মনে করে সদ্য লেখা আমার কবিতা পড়তে চাইলেন। তখন আমার বয়স কতো? ১৬/১৭। তখন মাত্র লেখালখি করার চেষ্টা করছি। যা লেখা হয়ে ওঠেনি, এখন বুঝতে পারি।

বাবা আমার একটি কবিতা পাঠ করছেন। কবিতার মাঝামাঝি যেয়েই বিশেষ একটি উপমা একাধিকবার পাঠ করলেন, তারপর অন্যমনস্ক হলেন। আমার মুখের দিকে তাকালেন একবার। কবিতার খাতায় চোখ রাখলেন একবার। জানালা দিয়ে অন্ধকার আকাশে ঝুলে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকালের একবার। তারপর এমন এক দৃশ্যের অবতারণ হলো যা কখনো আমি দেখিনি। তিনি শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুতই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি থ মেরে বসে আছি। তারপর ভাবলাম ইয়েটস-এর পাওয়া নোবেলের চেয়ে এই পদকের মূল্য ঢের মূল্যবান!

আমার পিতাকে আমি কখনো ‘বাবা’ ডাকিনি, ‘আব্বা’ বলে ডাকি। তার যৌক্তিক কারণও আছে। একটু বড় হয়েই, যখন বুঝতে শিখেছি, দেখলাম প্রতিবেশি কামরুল চাচারা তাদের পিতাকে ‘বাবা’ বলে ডাকছেন। তাদের পিতা তখন পৌঢ়। আমার মাথায় ঢুকলো নিশ্চয়ই বয়স্ক পিতাদের সবাই ‘বাবা’ ডাকেন, অপেক্ষাকৃত তরুণ পিতাকে ডাকতে হয় ‘আব্বা’! সেই থেকে আমি এবং আমার ছোট দুবোন বাবাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকি!

বাবাকে নিয়ে আমি কখনো সিরিয়াস লেখা লিখিনি। যেমন লিখিনি আমার প্রয়াত দাদা-দাদী ও বড় চাচা ডাক্তার আবু তাহের (তারা ডাক্তার) সাহবেকে নিয়ে। কথাশিল্পী স্বকৃত নোমানের সম্পাদনায় ‘সম্প্রীতির’ একটি বিশেষ সংখ্যায় এই মানুষগুলোকে নিয়ে একটি দীর্ঘ গদ্য আছে আমার। এছাড়া বিশেষ কিছু নেই। মাকে নিয়ে লিখেছি। তাও নামে মাত্র। নানীকে নিয়েও বিশেষ লেখা নেই। তার বড় কারণ হলো এঁদের নিয়ে লিখতে গেলে এতো বেশি আবেগি হয়ে পড়ি, বুকের ভেতরের নদীটার ঢেউ বড্ড লাফালাফি করে অস্থির করে তুলে আমার সংবেদনশীলতরীকে যে শেষ পর্যন্ত মাঝিকে হাল ছেড়ে দিতেই হয়!

তবে হ্যাঁ, আমি জানি এঁদের নিয়ে মহান আল্লাহ বাঁচালে কোনো একদিন ধ্রুপদী লেখাটাই আমি লিখবো। তা হোক অল্প।

বাবা আমার কাছে শুধু বিল্পবী-ই নন। দার্শনিকও। সক্রেটিশকে জানার আগে আমি বাবাকে জেনেছি। সক্রেটিশকে আমি দেখিনি। আমার সৌভাগ্য বাবাকে দেখছি। আমার মনে পড়ে, কী ভেবে একদিন বাবাকে বলেছিলাম নজরুলের বিদ্রোহীর ‘আমি’র ভেতর আপনাকে দেখি, যেমন দেখি চে’র মুখ, বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ তর্জনী ও শরৎ বাবুর ‘পথের দাবী’র সব্যসাচীর মধ্যে। এমনকি আহমদ ছফার মানসজমিনেও! কী যেন ভেবে বাবা মুচকি হেসে বললেন- লেখালেখিটা ছেড়োনা। যতোটা লিখবে তারচে পড়বে বেশি-কি মানুষ কি পুস্তক কি প্রকৃতি কি স্রষ্টা! আর চেষ্টা করবে অসহায় মানুষের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি থাকতে, পাঁজরের কাছাকাছি থাকতে!

আব্বা এমনিতেই আমাকে ‘তুই’ বলেন, আবেগি হয়ে গেলে বলেন ‘তুমি’। বাবা ও আমার সম্পর্কটা অনেকটা দার্শনিকসুলভ। যতোটা না পরস্পরকে বাইরে থেকে ডাকি, তারচে ঢের বেশি ডাকি ভেতর থেকে, হৃদয় দিয়ে!

পৃথিবীর সকল বাবা ভালো থাকুন।

লেখক: কবি ও গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :