অসচেতনতায় করোনা সংক্রমিত বাড়ছে প্রাথমিকের পরিবারে

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৭ জুন ২০২০, ১৬:৩০ | প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২০, ১১:১৫

করোনা মহামারির মধ্যে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকেরা। একইসঙ্গে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাথমিকের পরিবারে মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। আবার উপসর্গ থাকার পরও অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন না। একারণে গুরুত্বপূর্ণ এই পেশাজীবীদের আরও সচেতন হতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের তথ্য সংগ্রহ করে ডিপিইর ওয়েবসাইটে প্রতিদিন আপডেট করা হচ্ছে। এখানে সোমবার থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দুই শিক্ষক ও এক কর্মকর্তা করোনায় মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে একজন শিক্ষক করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যেও প্রাথমিকের শিক্ষকেরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবে এখনো অনেক শিক্ষক সামাজিক ভীতির কারণে করোনা পরীক্ষা থেকে বিরত থাকছেন। ফলে অদৃশ্য এই ভাইরাসের সঠিক তথ্য গোপন থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই করোনার উপসর্গ থাকার পরও পরীক্ষা করাচ্ছেন না বলে তথ্য মিলেছে খোদ এক শিক্ষক নেতার কণ্ঠে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এতদিন পর্যন্ত অধিকাংশ শিক্ষক মাঠ প্রশাসনের কাজ, সরকারঘোষিত মানবিক সহায়তার কাজ এবং বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি, ডিআরসহ বিভিন্ন তথ্য হালনাগাদ করেছেন। সেসময় বহু মানুষের সংস্পর্শে ছিলেন তারা। ফলে কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখনো অনেক শিক্ষক আক্রান্ত আছেন। যারা বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিন্তু কোনো প্রকার টেস্ট করায়নি।’

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা আক্রান্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্য সংগ্রহের প্রধান সমন্বয়ক সহকারি পরিচালক আতাউর রহমানও করোনায় আক্রান্ত। এখন তার পরিবর্তে শিক্ষা কর্মকর্তা শরীফ কাজ করছেন।’

করোনায় মৃত্যু হওয়া শিক্ষকের মধ্যে একজন মো. খয়বর আলী। ঈদের পর দিন শরীরে প্রচণ্ড জ্বর, ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে নমুনা পরীক্ষা করে তার শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। মঙ্গলবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে তার মৃত্যু হয়।

ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে তার বাড়ি। ঢাকার গুলশান এলাকার উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ঢাকা মহানগর বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন খয়বর আলী।

শিক্ষকদের মধ্যে অন্যজন নুরুল হক করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার যাত্রাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের আরো এক সদস্য ভোলা জেলার এডিপিও খলিলুর রহমানও মারা গেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বরিশালের এক হাসপাতালে নেয়ার পর মঙ্গলবার সকালে মৃত্যু হয়।

এছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরো একজন শিক্ষক। তিনি আবদুল খালেক। হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন দেশখাগুড়িয়া সপ্রাবির সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একদিনেই তিনজনের মৃত্যু খুবই অবাক করে দিয়েছে। শুরু থেকেই প্রাথমিকের পরিবারের যে কোনো সদস্য করোনা আক্রান্ত হলেই যেন জানা যায় সেজন্য একটা ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে।’

‘করোনা আক্রান্তদের তথ্যগুলো প্রতিদিনই সেখানে জড়ো করা হচ্ছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছি। তাদের চিকিৎসার জন্য সার্বিক সহায়তা দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তাই আক্রান্তদের এবং মৃতদের পরিবারের সহযোগিতার ব্যাপারে পরিকল্পনা করা হচ্ছে’-যোগ করেন মো. ফসিউল্লাহ।

ডিপিইর ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সারাদেশে এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের ২১৮ জন শিক্ষক কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৭১ জন শিক্ষক, ২৬ জন কর্মকর্তা, ১০ জন কর্মচারী ও ১১ জন শিক্ষার্থী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩ জন শিক্ষক ও একজন শিক্ষা কর্মকর্তা মারা গেছেন। সর্বমোট মারা গেছেন ৪ জন। এ পর্যন্ত ৩৬ জন সুস্থ হয়েছেন। ২৬ জন শিক্ষক, ৫ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী একজন ও ৪ জন শিক্ষার্থী সুস্থ হয়েছেন। এদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন তিন জন।

তবে করোনা আক্রান্ত শিক্ষকদের বেশিরভাগই ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার। এরপরের অবস্থান চট্টগ্রামের। ঢাকায় করোনা আক্রান্ত শিক্ষক ৭৯ জন, চট্টগ্রামে ৬৫, রাজশাহী বিভাগে ১২ জন, খুলনায় ৯ জন, বরিশালে ১৫ জন, সিলেটে ২০ জন, রংপুরে ৮ জন এবং ময়মনসিংহে ৮ জন রয়েছেন।

উপসর্গ থাকার পরেও অনেক শিক্ষকের করোনা পরীক্ষা না করানোর বিষয়ে হতবাক হয়েছেন শিক্ষাবিদেরা। উপসর্গ দেখা মাত্র শিক্ষকদের দ্রুত করোনা পরীক্ষা করানো উচিত বলেও মনে করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষকরা সমাজের অগ্রগামী মানুষ। যদি করোনা লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে সর্বপ্রথম শিক্ষকদের অবশ্যই করোনা টেস্টে এগিয়ে আসা উচিত।তারা যদি তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করেন তাহলে অন্যরা কি শিখবে?’

‘তাই উপসর্গ দেখা মাত্র শিক্ষকদের অবশ্যই নিজে মনোভাব ঠিক রেখে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করা উচিত। এছাড়া যারা সুস্থ হয়েছেন তারা সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছাতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। তাহলে অন্যরাও করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং করোনা টেস্টে উৎসাহী হবে।’

তবে শিক্ষকদের করোনা পরীক্ষা না করানোর কারণ হিসেবে সামাজিক ভীতিকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষক নেতারা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামছুদ্দিন মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দেশে প্রথম করোনা আক্রান্তের সময় থেকে আজকে পর্যন্ত করোনা রোগীদের নিয়ে আমাদের এক রকম ভীতি ছিল। যদিও এরপরে এই ভীতি অনেকটা কমেছে। তবে এটা এখনো আছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটা প্রবল।করোনা আক্রান্তের কথা শুনলেই সে বাড়ির আশপাশ পর্যন্ত কাউকে চোখে পড়ে না।’

‘ফলে অনেকেই উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষার দিকে আগ্রহী হচ্ছেন না। শিক্ষকরাও সমাজের বাইরে নন। তাই অনেক শিক্ষক উপসর্গ থাকলেও সামাজিকভাবে অপদস্ত হওয়ার ভয়ে তথ্য গোপন রাখছেন।’

তবে খুব শিগগির করোনার উপসর্গ দেখা মাত্র টেস্ট করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশে প্রধান শিক্ষকদের সাথে ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে এবিষয়ে একটা পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানিয়েছেন এই শিক্ষক নেতা।

দেশে মার্চের শুরু থেকে করোনা শনাক্তের পর প্রতিদিনই সেই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিনই মৃত্যু তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। তাই সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষ হিসেবে শিক্ষকদের নিজের সচেতনতা বাড়ানো এবং অন্যদেরকেও সচেতন করাই হতে পারে মহামারীর মোকাবেলার অন্যতম উপায়।

(ঢাকাটাইমস/১৭জুন/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :