জীবনের পড়ন্ত বিকেলে...

জহির রায়হান
| আপডেট : ২০ জুন ২০২০, ২৩:০৪ | প্রকাশিত : ২০ জুন ২০২০, ২২:৫৪

মাথায় প্রচণ্ড আঘাত নিয়ে বসে পড়লেন মালেক সাহেব। আসলে মাথার আঘাতের চেয়ে তার মনেই আঘাত লেগেছে বেশি। যে নাতিদের কোলে করে বড় করেছেন তারাই রুমে ঢুকতে দিচ্ছে না। দরজা এমনভাবে বন্ধ করেছে যে, আর একটু হলে মাথাটা দু ভাগ হয়ে যেত। ব্যথার দিকে কোনো খেয়াল নেই এখন মালেক সাহেবের, তিনি এখন ফিরে গেছে হারানো সেই দিনে।

‘তিলে তিলে সন্তানদের মানুষ করেছেন। ঢাকার অভিজাত স্কুলে তাদের পড়িয়েছেন। ঢাকায় একটি বাড়িও করেছেন। স্বপ্ন ছিল বৃদ্ধ বয়সে নাতি নাতনিদের সঙ্গে গল্প করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তা স্বপ্নই থেকে গেছে তার।’

নিজের করা বাড়ির সাত তলায় একটি রুম বরাদ্দ হয়েছে মালেক সাহেবের জন্য। সারাদিন তার সেখানেই কাটে। মাঝে মাঝে বারান্দায়, ছাদেও যাওয়া হয়। বার্ধক্যের কারণে এখন আর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা হয় না। সাত তলার উপর থেকে যখন পরিচিত কাউকে হেঁটে যেতে দেখলে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হয় না।

বাসায় এতো মানুষ, কিন্তু মালেক সাহেবের সঙ্গে কথা বলা যেন কেউ নেই। কথা বলতে না পারলেও ছোট নাতি আগে দাদার কাছাকাছি থাকত। তখন তার সময়ও ভালো কাটত। কিন্ত এখন সে কথা বলতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে কোনটা ময়লা আর পরিষ্কার। তাই ময়লা দাদুর রুমে আর সে ঢুকে না।

এই তো সেদিন মলমূত্র দিয়ে বিছানা নষ্ট করে ফেলায় কত কথাই না শুনতে হয়েছে মালেক সাহেবকে। তা মনে পড়লে গা শিউরে উঠে।

বুকভরা কষ্ট নিয়ে স্মৃতিগুলো হাতরাচ্ছেন মালেক সাহেব, ‘এইতো কয়েক বছর আগেও কারওয়ান বাজার থেকে প্রতিদিন টাটকা বাজার এনে সবাইকে খাওয়াতাম। ফজরের নামাজ আদায় করে তারপর বাজারে যেতাম। দু’হাতে ব্যাগ ভরে টাটকা শাকসবজি, কত ফল নিয়ে আসতাম। কিন্তু আজ যখন পাটশাক ভাজা খেতে মনে চায়, তখন কথা ওঠে কে আনবে শাক। ছেলের বউদের কী বলবো ছেলেরাই তো কাছে আসে না, পাশে বসে জিজ্ঞাসা করে না বাবা তোমার কিছু লাগবে? তারা যখন কথা বলে তখন মনে হয় বদরাগি বস তার কর্মীদের সাথে কথা বলছে।’

নাতনিদের কোলে নিয়ে যখন চুমু খাচ্ছে ছেলেরা আর বলছে ওরে আমার সোনা বাবাটা। তখন সন্তানদের খুব বলতে ইচ্ছে করে একদিন তোদেরও তো এভাবে সোনা বাবু বলছি। তোদের কত আবদার মিটিয়েছি। কিন্তু আজ যখন আমি ‘শিশু’ হয়ে গিয়েছি। তোরাতো আমার আবদার মিটাও না। তোদের কত কথার জবাব দিয়েছি হাসি মনে। আর আজ তোরা আমার কথার মূল্যই দেস না। ভাবতে ভাবতে চোখের পানিতে বুক ভিজে যাচ্ছে মালেক সাহেবের।

মালেক সাহেবের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মানুষের মাঝে। নিজ এলাকায় সুনামও ছিল বেশ। এলাকায় কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার ফয়সালার জন্য ঢাক পড়তো মালেক সাহেবের। সর্বজন শ্রদ্ধেয় হওয়ায় সবাই তার ফয়সালাও মেনে নিত সবাই।

কিন্তু আজ নিজের সংসারের কোনো সিদ্ধান্তে তার মতের কোনো প্রয়োজন হয় না! একটা রুমেই কাটে সময়। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর যতদিন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারতাম ততদিন ভালোই ছিল সময়টা। স্ত্রী-ছেলেরা তাদের মতো করে সময় কাটালেও নিজেকে একা মনে হতো না। রাস্তায় নামলে দাদা কেমন আছেন। চাচা কেমন আছেন। আপনার শরীর কেমন আছেন কতজন জানতে চাইত।

মুয়াজ্জিনের সঙ্গে গল্প করা, এলাকার মুরুব্বিদের সঙ্গে বিকালে রমনায় হাঁটতে যাওয়া। ভালোই কাটতো সময়।’সামনের দিনগুলো কেমন হবে এখন ভাবছে মালেক সাহেব। সন্তানদের নিয়ে ভাবনাগুলো কুড়ে খাচ্ছে মালেক সাহেবকে, ‘আচ্ছা তোদের কি একটুও মনে পড়ে না সেইসব দিনের কথা। কত গল্প শুনিয়ে তোদের ঘুম পড়াতাম। আর আজ তোরা বিবাহবার্ষিকী পালন করো, ছেলের জন্মদিন পালন করো। অথচ আমাকে একবারের জন্যও ডাকো না। আজ বড় বেমানান হয়ে গেছি তোদের কাছে তাই না? তোরা তো মনে করিস, অনুষ্ঠান শেষে কেক আর মিষ্টি দিলেই সব হয়ে যায়। কিন্তু তোরা তো জানো না, যখন সবাই কথা বলো আর হাসাহাসি করো আমারও ইচ্ছে করে তোদের হাসির সঙ্গে হাসি মেলাতে। আমারও ইচ্ছে করে জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো তোদের কাছে বলতে। আচ্ছা তোদের সঙ্গে স্যুটেট বুটেড ছবিগুলোর দিকে তোদের চোখ কি কখনও গিয়েছে। কীভাবে বুঝাবো আমিও তোদের মতো পরিষ্কার ছিলাম। আমার শরীর থেকেও ঘ্রাণ আসতো। আমার গায়ের চামড়াও টান টান ছিল। আমার কথারও জোর ছিল।

আচ্ছা নাতিরা যখন মুখের সামনে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় তখন কি তোরা বোঝাস এমন করে না বাবা। তোমার দাদু তো, দাদুকে আসতে দাও। কই একদিনও তো দেখলাম না। বরং মনে হয় তোরা চুপে চুপে বলো ঠিকই করছো এই বুড়োটা এই রুমে কি চায় তার রুমে থাকতে পারে না। আরে তোরা কীভাবে বুঝবি এখন আমি শিশু হয়ে গিয়েছি। শিশুরা কি একা থাকতে পারে?

আর ভাবতে পারেন না মালেক সাহেব, মনে হয় মৃত্যু এ থেকে তাকে পরিত্রাণ দিতে পারে। এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা!

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :