অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম: বিবেচনায় নিতে হবে যেসব বিষয়

ড. মো. মনির উদ্দিন
| আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২০, ১৬:৪৬ | প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০২০, ১৭:১৩

“উন্নত দেশ সব প্রায় একই রকম; প্রত্যেক অনুন্নত দেশ অনুন্নত তার নিজের মতো করেই।” আব্দুল বায়েস ও মাহবুব হোসেন তাদের ‘তিন বিঘা জমি’ গ্রন্থে লিও টলোস্টয়ের আনা কারেনিনা উপন্যাসের উক্তির অনুকরণে এই উক্তিটি করেন।

করোনা মহামারীর এই দুর্যোগকালে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করছে। অনেকে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, নাই মামার চেয়ে কানা মামা হিসেবে এর চেয়ে ভালো বিকল্পও নেই।

তবে এক্ষেত্রে লিও টলোস্টয় বা বায়েস ও হোসেনের অনুকরণে বলা যায়─ উন্নত দেশগুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালাবে প্রায় একই রকম করে; প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশ চালাবে তার নিজের মতো করে। বিষয়টি যদি একটু খোলাসা করে বলি তাহলে এমন হয়─ উন্নত দেশে প্রত্যেক নাগরিকের অনলাইন সুবিধা অবারিত; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একেক দেশের একেক রকম বাস্তবতার কারণে এ সুবিধা সকল নাগরিকের কাছে অবারিত নয়।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ইচ্ছে করলেই উন্নত দেশের মতো করে শুরু করে দিতে পারে না। কারণ বাংলাদেশের উপেক্ষা না করতে পারার মতো অনেক সমস্যা রয়েছে। সরকারপ্রধান হয়তো সে কারণেই করোনা সংক্রমনের প্রথম দিকেই বলেছিলেন যে─ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কেও বলতে শুনেছি যে─ তিনিও করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার পক্ষে।

যদিও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে, এমনকি কোনও কোনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিকভাবে হলেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা পারে, কারণ তারা উন্নত দেশের অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছে। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্পোরেট চরিত্রের কারণে এ ধরণের সক্ষমতা থাকতেই হবে।

যাইহোক এ কার্যক্রম বিভিন্ন স্কুল-কলেজও ইতোমধ্যে শুরু করেছে; আবার অনেক প্রতিষ্ঠান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছে। তবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ অন্তর্ভূক্তিমূলক অংশগ্রহনের বিষয়ে বিশেষ যত্নশীল হওয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার যৌক্তিকতাও এখন স্পষ্ট। কারণ করোনাভাইরাস হয়তো আমাদের দেশে দীর্ঘস্থায়ী হবে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকেও প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে এরকম শিক্ষা থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়। সেকারণে এখন থেকেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাই বলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর নামে অগোছালোভাবে ঝাপিয়ে পড়াও উচিৎ হবে না।

শিক্ষা হলো দীর্ঘ মেয়াদে অর্জন করে, অর্জিত জ্ঞান অরো দীর্ঘ মেয়াদে কাজে লাগানোর বিষয়। এটি আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের মতো কোনও তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী বিষয় নয়। যেমন পুলিশ যদি এক ঘন্টার জন্যও কর্মবিরতি পালন করে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম যদি অনিবার্য কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার অবকাশ নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এখন তাড়াহুড়া করে কিছু করতে গিয়ে উল্টো ক্ষতি বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করাও ঠিক হবে না।

সরকার তার দায়িত্ববোধ থেকে হয়তো তাড়াতাড়ি শুরু করতে চায় এবং সরকার হয়তো ভাবছে যে─ জনগণও এমনটাই চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা ভুল করলে চলবে না। তাড়াহুড়োর ফল বরং খারাপ হতে পারে; অভিভাবকদেরও এই বিষয়টি বুঝতে হবে। কারণ আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আগে প্রয়োজন সেই সীমাবদ্ধতগুলো চিহ্নিত করা, তারপর সমাধানসূত্র নির্ধারণ করা। তারপরই কেবল একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সুসমন্বিতভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া।

সবকিছুর আগে যে বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে তা হলো অন্তর্ভূক্তি-সংবেদনশীলতা। এমনিতেই বাংলাদেশের যে উন্নতি হচ্ছে, তা হচ্ছে মারাত্মক বৈষম্যমূলকভাবে। এর চরম প্রকাশ আমরা করোনাকালেও দেখতে পাচ্ছি। কেন বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যও এতো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে? উত্তর একটাই─ একচেটিয়া সুবিধাভোগের মনোভাব। অর্থাৎ, সকলকে বাদ দিয়ে আমি বা আমরা কয়জন ধনী হবো; ক্ষমতাবান হবো; সুবিধা নেবো; সবকিছু ভোগ করবো ধরনের মনোবৃত্তি।

একচেটিয়া সুবিধা ভোগের বিষয়টি এই মহামারীর দিনেও ব্যাপক হারে চলমান আছে। বলা যায় এটি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুরারোগ্য ব্যাধি, যার সূচনাকাল অজানা, যা ব্রিটিশ আমলে তীব্র, আর বর্তমান বাংলাদেশে তীব্রতর হয়েছে। আমরা কেউই হয়তো এই একচেটিয়া সুবিধাভোগের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত নই!

সাম্প্রতিককালে, সামরিক বাহিনীর বাইরের অনেক প্রভাবশালী লোক সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধানকর্তাও তার অধীনের হাসপাতালে ভরসা রাখতে না পেরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

অপরদিকে সাধারণ মানুষের অনেকেই চিকিৎসা ছাড়াই নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করছেন। এই যে একটা শ্রেণি এভাবে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে এটাই হলো একচেটিয়া সুবিধা। এই সুবিধার বিপরিতে রয়েছে অন্তর্ভূক্তিতমূলক সুবিধা। অর্থাৎ যে কোনও বিষয়ে সকলে সমানভাবে অন্তর্ভূক্ত থাকবে; কেউ বাদ যাবে না।

সকলের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি আমাদের সংবিধানেও নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের চোখে সকল নাগরিক সমান। সে অনুযায়ী, সর্বক্ষেত্রেই প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে; একজন নাগরিকও সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংবিধানে এমন অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যবস্থা থাকলেও, রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে অনেক অন্যায্য (কিছু ন্যায্য বিষয়ও আছে) প্রাধিকার ব্যবস্থা তৈরি করে অনেক ক্ষেত্রেই সেই অন্তর্ভুক্তির সুবিধাকে হটিয়ে একচেটিয়া সুবিধার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এই প্রাধিকার নামের একচেটিয়া সুবিধার অপব্যবহার ও দৌরাত্মের কারণে প্রায়শই অনেক নাগরিকের হয়রানির, এমনকি মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পারি।

সাধারণ মানুষ এখন দিশাহারা হয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে কালাতিপাত করছে। তারা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সবদিক দিয়েই বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে যদি মানুষকে আবার সেই বৈষম্যের শিকার হতে হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়!

দেখা যাবে শুধু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা এই সুবিধাটি নিতে পারছে; আর অস্বচ্ছলরা বঞ্চিত হচ্ছে। যারা এ সুবিধাটি নিতে পারবে না, তারা মানসিকভাবে আরো ভেঙ্গে পড়বে। তাই একজন শিক্ষার্থীও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

সেজন্য শতভাগ সংবেদনশীলতার সাথে অন্তর্ভুক্তিমুলক অংশগ্রহনের বিষয়টি ভাবতে হবে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা ছাড়াও, শিক্ষার্থীদের অবস্থানে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং তাদের শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও আর্থিক বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে।

শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে

১. নির্দিষ্ট ক্লাসের নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের শতকরা কতজন স্বাভাবিকভাবে ক্লাসে অংশগ্রহন করতে পারবে।

২. যারা অংশগ্রহন করতে পারবে না, তারা কেন পারবে না।

৩. সকলের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সুবিধা আছে কিনা (স্মার্টফোন আছে কিনা, না থাকলে তা বিনামূল্যে বা দীর্ঘ মেয়াদী ঋণে সরবরাহ করা যায় কি-না)।

৪. ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় সেরকম অবস্থানে আছে কি-না, না থাকলে তার ব্যবস্থা করা।

৫. ইন্টারনেট সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আছে কি-না বা বিনা খরচে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া।

৬. যারা অসুস্থতা বা অন্য কারণে কোনও ভাবেই অংশগ্রহন করতে পারবে না, তাদের ক্লাস কনটেন্ট পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

শিক্ষকদের জন্যও কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে

১. শিক্ষকদের শারীরক, মানসিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া।

২. সকল শিক্ষক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত কি-না।

৩. প্রযুক্তি ব্যবহারে কোন ধরনের পাঠ পরিকল্পনা ও পাঠ উপস্থাপনা প্রয়োজন।

৪. তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন কম্পিউতার, প্রিন্টার, স্ক্যানার প্রভৃতি আছে কি-না।

৫. শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হবে কি-না।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে, প্রথমে একটি সমীক্ষা, সমীক্ষার ফল অনুযায়ী একটি পরিকল্পনা, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তুতি এবং প্রস্তুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর সব কিছুর জন্যই প্রয়োজন একটি অনলাইন ক্লাস বাস্তবায়ন কমিটি ও অনলাইন ক্লাসের জন্য বিশেষ অর্থের বরাদ্দ।

করোনাকালের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তুতি পর্ব পর্যন্ত শেষ করতেও মাসাধিক সময় লেগে যেতে পারে। এতটা সময় যেহেতু চলেই গেছে, আরেকটু সময় লাগলেও, বহুশৃংখলার বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ নেতৃত্বের অধীনে অন্তুর্ভূক্তিমূলক সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন।

দক্ষ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ওপরেই নির্ভর করছে এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সাফল্য। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও একচেটিয়া সুবিধাভোগের সংস্কৃতি মহামারীর মতোই ছড়িয়ে আছে বিধায় অন্তর্ভূকিতমূলক অংশগ্রহনের কথা কোনও ভাবেই ভুলে গেলে চলবে না।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :