[পর্ব ০৪]

তুমি রবে সরবে...

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২০, ১৪:০১ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২০, ১৪:২২

পাভেল রহমান

ত্রিশ দিন হয়ে গেলো মোস্তফা কামাল সৈয়দ আমাদের মাঝে নেই। যারা তাকে চেনেন, তারা নিশ্চিতভাবেই স্বীকার করবেন যে, বিশ্বাসই হয়না তিনি নেই! আমারও তাই মনেহয়। তাঁর মতো মানুষের মৃত্যু হয়না।

কামাল স্যার অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মিডিয়ার অসংখ্য মানুষ নিয়মিত খোঁজ খবর নিয়েছেন। কার কথা বলবো! নাট্যকার, নির্মাতা, অভিনেতা, সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেকেই আমাদের ফোন করে জানতে চেয়েছেন তাঁর সর্বশেষ অবস্থা। তাঁর মৃত্যুর পরও অনেকে করোনার ভয় উপেক্ষা করে জানাজায় শরিক হতে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। কয়েকজন আবার ঠিকই উপস্থিত হয়ে গেছেন কবরস্থানে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শেষ সময় পর্যন্ত এতো এতো মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। আমি স্যারের পরিবার ও এনটিভি'র পক্ষ থেকে সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

স্যারের মৃত্যুর দিন রাতে একজন জনপ্রিয় নাট্য-নির্মাতা আমাকে ইনবক্সে লিখলেন, 'কীভাবে যাবেন স্যারের রুমটায় আর?' বলেছিলাম, 'আমি সত্যিই জানিনা। আজ নামাজ পড়তে গিয়ে ডানে সালাম ফেরাতেই রুমটার দিকে যখন চোখ গেলো, কান্না আসছিলো। সব সেভাবেই পড়ে আছে, শুধু মসনুষটাই নেই!' আজই প্রথম স্যারের রুমে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। হয়তো এটাই শেষ।

মোস্তফা কামাল সৈয়দকে আমি 'ভাই' বলতে খুব সঙ্কোচ বোধ করতাম। লক্ষ্য করতাম, স্যারের নাতির বয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে তাঁকে অবলীলায় 'ভাই' বলে সম্বোধন করতো। যদিও মিডিয়ায় 'ভাই' সম্বোধন করাটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু 'কামাল ভাই' বলে যারা ডাকতেন, তাঁরা কামাল ভাইয়ের বন্ধুবৎসল আরচণের জন্যই পশ্রয় পেয়েছিলেন।

কেউ আবার আঙ্কেল, ভাইয়া, চাচা, কাকা নামেও ডাকতেন তাঁকে। কেউ কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করতেন, যদিও স্যার এটা পছন্দ করতেন না। স্যার যাঁকে খুব পছন্দ করতেন, তাদের মাথায় হাত রাখতেন। তাঁর স্বভাবসুলভ কিছু আচরণ ছিলো! এর মধ্যে সিগনেচার ছিলো তাঁর নাক কচলে কথা বলা। অনেকেই তাঁর অগোচরে এটা অনুকরণ করতেন দুষ্টামি করে। কিন্তু আমার তাঁকে 'স্যার' বলার কারণটা ছিলো ভিন্ন। আমার কাছে তিনি একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, গুরুজন; তাই আমার মুখ দিয়ে 'ভাই' বের হতোনা। বস অর্থে নয়, মন থেকে তাঁকে 'স্যার' বলে সম্বোধন করতাম।

মোস্তফা কামাল সৈয়দ সবাইকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করতেন। আমার ক্ষেত্রেও তাই করেছেন। অল্প সংখ্যক মানুষকে স্নেহ করে তিনি 'তুমি' সম্বোধন করতেন। তাঁর সঙ্গে এই একটা জায়গায় আমার মিল। আমিও পারিনা হুট করে অপরিচিত কাউকে 'তুমি' বলে ফেলতে। স্যারের এমন অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে, যা তাঁর সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের বহিঃপ্রকাশ। এমন পরিপাটি মানুষ সচরাচর দেখা যায়না।

 বিত্ত বৈভব থাকার পরও তিনি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। কখনোই তাঁর মধ্যে অহংবোধ, বিলাসিতা, অপচয় করার মানসিকতা দেখা যায়নি। কাজের ফাঁকে কখনো যদি একটু সময় পেতেন, চলে যেতেন পুরোনো দিনের কথায়। পুরনো কথা মানেও সেই কাজের কথা। মানে তার কর্ম অভিজ্ঞতার গল্পই শোনাতেন। কখনোই ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপচারিতা করতেন না।

আর এভাবেই তিনি আমাদের কাজ শেখাতেন। কখনো খুব রেগে গেলে শুধু বলতেন, আপনাদের কাজ শেখাতে পারলাম না! ব্যাস ওটুকুই শাসন! আমরা তাঁর থেকে আসলেই কিছু নিতে পেরেছি কি না, সেটা সময়ের হাতেই ছেড়ে দেই। তবে, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারবো, তাঁর মতো মানুষ হওয়া সাধনার বিষয়। অনেক ধ্যান, প্রজ্ঞা আর গভীর জীবনবোধ দরকার।

এতোটা ধৈর্য্য একটা মানুষ কীভাবে অর্জন করেন আমি জানিনা। তিনি সহজে উত্তেজিত হতেন না। অনেক প্রতিকূল সময়েও তাঁকে শান্ত থাকতে দেখেছি। কখনো উত্তেজিত হয়ে পড়লেও সর্বোচ্চ ঘন্টা খানেক সময় নিতেন শান্ত হতে। নামাজ পড়েই তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে করে ফেলতেন। একদম নিজের মতো করে কাজ আর প্রার্থনা নিয়ে ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন। কাজের ফাঁকে আপন মনে গুনগুন করে গাইতেন সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ'র গান বা রবীন্দ্রসংগীত। প্রাচ্যের সঙ্গীত নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা করে গেছেন। এনটিভি'র মিউজিক্যাল শোগুলো দেখলে আমরা তার প্রমাণ পাই। গান নির্বাচন থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের নাম পর্যন্ত ঠিক করে দিতেন তিনি। আমরা তাঁকে যতোটুকু দেখেছি, তার চেয়েও অনেক গভীর তিনি।

আজ এই দিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করি। তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়ে আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের আগামীর বন্ধুর পথ।  

লেখক: গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ঢাকাটাইমস/১জুলাই/এসকেএস