ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে লাদাখ কেন গুরুত্বপূর্ণ!

আবু বকর সিদ্দিক
 | প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০২০, ১৪:১৩

গত কয়েকদিন থেকেই চীন ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা লাদাখ ইস্যুতে পুরাই উত্তাল হয়ে আছে ভার্চুয়াল জগত। প্রায় যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এরকম একটা পরিস্থিতিতে যাচ্ছে লাদাখ সীমান্তের মানুষের জীবন। বিশ্বের বড় বড় কূটনীতিক ব্যক্তিবর্গ একেকজন একেকরকম মন্তব্য করছেন। লাদাখ কেন গুরুত্বপূর্ণ!

লাদাখের ইতিহাস কিছুটা জেনে আসি।লাদাখ উত্তরে কুনলুন পর্বতশ্রেণি এবং দক্ষিণে হিমালয় দ্বারাবেষ্টিত ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এই এলাকার অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতী বংশোদ্ভুত।ঐতিহাসিককাল ধরে বালটিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু নদ উপত্যকা, জাংস্কার, লাহুল স্পিটি, রুদোক ও গুজ সহ আকসাই চিন এবং নুব্রা উপত্যকা লাদাখের অংশ ছিল। বর্তমানে লাদাখ শুধুমাত্র লেহ জেলা ও কার্গিল জেলা নিয়ে গঠিত।

১৮৩৪ সালে ডোগরা আক্রমণের পূর্ব সময় পর্যন্ত লাদাখ ছিল স্বাধীন হিমালয় রাষ্ট্র। যেমনটা ছিল ভূটান ও সিকিম। ঐতিহাসিক এ সাংস্কৃতিকভাবে এই রাজ্য তিব্বতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো তা প্রায় বলাই যায়। লাদাখ ও তিব্বত ভাষাগত ও ধর্মীয়ভাবে যুক্ত ছিলো অনেক আগ থেকেই। যদিও বা রাজনৈতিক ভাবেও তাদের ছিল প্রায় এক রকমের ইতিহাস।

ঐতিহাসিক জন ব্রে তাঁর গবেষণাপত্র Ladakhi history and Indian nationhood-এ উল্লেখ করেছিলেন “লাদাখ ছিল তিব্বত সাম্রাজ্যের অংশ যা ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা লাংদর্মার মৃত্যুর পর ভেঙে যায়। এর পর এ রাজ্য হয়ে ওঠে স্বাধীন, যদিও ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এর সীমানাও পাল্টেছে, এবং বিভিন্ন সময়ে তা বর্তমান পশ্চিম তিব্বতের অংশ হয়েছে"।

অর্থনৈতিক ভাবেও এই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ কারণ মধ্য এশিয়া ও কাশ্মীরের মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র গুদামস্থল।” ব্রে লিখেছিলেন, “তিব্বতের পশম শাল উল লাদাখ হয়ে কাশ্মীর যেত। একই সঙ্গে কারাকোরম পাস হয়ে ইয়ারকন্ড ও কাশনগরের মধ্যে দিয়ে চিনা তুর্কিস্তান পর্যন্ত পথ বাণিজ্যের রাস্তা হিসেবে বেড়ে উঠেছিল।” এইসব কারণেও লাদাখ এই ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা অঞ্চল হয়ে উঠে।

চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখন হঠাৎ করে এই করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এই সঙ্কট শুরু হলো কেন?

পশ্চিমা এবং ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক লিখছেন, বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বলয় বিস্তারের চেষ্টা চীন বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সারা বিশ্ব যখন বিষন্ন তখন বেইজিং এটাকে একটা লক্ষ্য পূরনের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। শুধু সীমান্তে চাপ তৈরি নয়, হংকংয়ে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে চীন।গত কয়েকদিন আগেও দেখা গেছে যে হংকং এ নানারকম আন্দোলন এবং প্রতিবাদ বেষ্টনী তৈরী হয়েছে। অনেক প্রতিবাদী মানুষ রাস্তায় দাড়িয়ে আন্দোলন করছে।

অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরও সঙ্কটে পড়া দেশগুলোকে ঋণ-সাহায্য দিয়ে অনেকটা একইভাবে বেইজিং তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।এখন দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের দিকেও এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে চীন সরকার।

তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাদাখ সীমান্তের গালোয়ান উপত্যকায় গত কয়েকবছর ধরে ভারত যেভাবে রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো তৈরি করছে তাতে চীন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, এবং ভারতের এই কর্মকাণ্ড তারা আর মেনে নিতে রাজি নয়।

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, চীন ও ভারতের সীমান্ত রেখা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ ঐতিহাসিক, “কিন্তু গত দশ-বারো বছরে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ভারত যেভাবে ব্যাপক হারে অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে তাতে চীন বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বিগ্ন।“

তিনি বলেন, ভারতে কট্টর জাতীয়তাবাদী একটি সরকারের ক্ষমতা-গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক নৈকট্যে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দিন দিন আরো বাড়ছে।

হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমসে তার এক লেখায় সুইডিশ বিশ্লেষক বার্টিল লিনটার বলছেন, লাদাখে ভারতের সড়ক নির্মাণকে চীন একটি হুমকি হিসাবে দেখতে শুরু করেছে।

তিনি বলছেন, বিশেষ করে পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের রাজধানী লাশা পর্যন্ত সামরিক কৌশলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে মহাসড়ক চীন তৈরি করেছে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ভারত আর চীনের মধ্যে লাদাখ ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য অনেক দিনের। দু দেশ বারবার সমাধানে বসেছে অনেক কিছু হয়েছে অনেক চুক্তি করেছে কিন্তু শেষমেশ আবার তাদের সীমান্তে তারা উত্তাপ ছড়ায়।

বহিবির্শ্বে চীন নিজেদের একটা প্রভাব এবং বলয় তৈরী করার জন্য ই লাদাখ সীমান্ত কেন্দ্র করে অনেক দিন থেকেই তোড়জোড় করে আসছে। আধতে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিবে তা আপাতত স্পষ্ট না। দুই দেশের পরিস্থিতি খুব স্পষ্ট নয়। কেউ কাউকে ছাড় দিতেও রাজি না। প্রতিটি দেশ তাদের নানারকম যুদ্ধযান সীমান্তে মজুদ করে রাখছে।

প্রতিটি দিন নানারকম গুঞ্জনে অতিবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ চাচ্ছে তাদের মধ্যে একটা সমাধান এবং বৈরিতা মনোভাব কমিয়ে আনার জন্য৷ আধতে লাদাখ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি কোনদিকে মোড় নিবে তা ঠিক করে বলা যায় না। পরিস্থিতিই হয়তোবা কোন সিদ্ধান্ত নিবে আসলেই কি অবস্থা তৈরী হবে এই দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে।

প্রকৃতপক্ষে এশিয়ার রাজনীতির মোড়ল এই দুই দেশ নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য মাঝেমধ্যে সীমান্তে জানান দেয়৷ পরিস্থিতিই আবার বলে দিবে লাদাখ সীমান্ত ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেনো এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ।

রেফারেন্স: উইকিপিডিয়া, ইন্ডিয়ান টাইমস এবং ইন্টারনেট

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :