লিবিয়া ঘিরে তুরস্ক-ফ্রান্সের বিতণ্ডা তুঙ্গে

প্রকাশ | ০৩ জুলাই ২০২০, ০৮:৫১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস

ফ্রান্স, তুরস্কের সঙ্গে বড়ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পর ন্যাটোর একটি নিরাপত্তা তৎপরতায় তাদের ভূমিকা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে তুরস্ক, লিবিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লংঘন করায় অপারেশন সি গার্ডিয়ান নামে সাগরে ন্যাটোর নিরাপত্তা অভিযানে ফ্রান্স এখন অংশ নেবে না।

তবে কয়েক সপ্তাহ আগে ফ্রান্স অভিযোগ করে যে, তুরস্কের জাহাজ, ভূমধ্যসাগরে ফরাসী রণতরীকে লক্ষ্য করে তাদের অস্ত্র তাক করেছে, যে অভিযোগ তুরস্ক জোরেসোরে অস্বীকার করেছে। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িতদের পক্ষ সমর্থনের ব্যাপারে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

ন্যাটো সমর্থিত বাহিনী ২০১১ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তেল সমৃদ্ধ দেশটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রধান একটা ট্রানজিট দেশ হয়ে উঠেছে লিবিয়া।

বর্তমানে লিবিয়ায় জাতিসংঘের সমর্থন পুষ্ট সরকার বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খালিফা হাফতারের বাহিনীর সাথে লড়ছে। লিবিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বড় অংশ এই মুহূর্তে খালিফা হাফতারের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

লিবিয়ার সঙ্কট, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা, এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল উত্তোলন নিয়ে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ক্রমশই তিক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে বড়ধরনের চিড় ধরে ১০ই জুন, যখন ফরাসী রণতরী কুরবে লিবিয়ার উপকূলে তানজানিয়ার পতাকাবাহী মালবাহী জাহাজ সারকিন পরিদর্শন করতে যায়। কুরবের লক্ষ্য ছিল দেখা যে, সারকিন অস্ত্র চোরাচালান করছে কিনা।

ন্যাটোর 'অপারেশন সি গার্ডিয়ান' তৎপরতার উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে নৌচলাচলের স্বাধীনতার ওপর নজর রাখা এবং নৌচলাচলকে সন্ত্রাসী হামলার হুমকি থেকে রক্ষা করা। যে ঘটনা নিয়ে বিতণ্ডা সে সময় ফরাসী জাহাজ কুরবে ন্যাটোর এই তৎপরতায় অংশ নিচ্ছিল। কিন্তু এর পর আসল ঘটনা কী ঘটেছিল তা নিয়েই বেঁধেছে এই বিতণ্ডা।

ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, তুরস্কের জাহাজ এই সময় সারকিন জাহাজটিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তুরস্কের বক্তব্য ছিল ওই জাহাজে চিকিৎসা সরবরাহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সময় তুরস্কের জাহাজ তাদের ফ্রিগেট রণতরী কুরবেকে লক্ষ্য করে আগ্রাসী আচরণ করে। এমনকী তিন বার তুরস্ক কুরবেকে লক্ষ্য তাদের অস্ত্র তাক করে বলে ফ্রান্স অভিযোগ করে।

তুরস্ক ফ্রান্সের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে তাদের ওই যোগাযোগ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। ফ্রান্স ন্যাটোর প্রতি ওই ঘটনার তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

দুই দেশই সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে পরস্পরের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছে। সম্প্রতি ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাকরোঁ তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, 'তুরস্ক ন্যাটোর একটি সদস্য দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও লিবিয়ার সংঘাতে দেশটি ঐতিহাসিক এবং অপরাধমূলক ভূমিকা নিয়েছে'।

আর এরপর মঙ্গলবার তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু বলেন যে, উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে ফ্রান্স একটা বিধ্বংসী ভূমিকা পালন করছে। তিনি অভিযোগ করেন ফ্রান্স লিবিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বৃহস্পতিবার তিনি আরও বলেন, কুরবে রণতরীটি নিয়ে এমন অভিযোগ তোলার জন্য ফ্রান্সের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

খবরে জানা যাচ্ছে ন্যাটোর 'অপারেশন সি গার্ডিয়ান' তৎপরতা থেকে ফ্রান্স নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবার পর ফ্রান্সের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, 'ন্যাটোর মিত্র দেশ যেখানে জোটের দেয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান দেখায় না, সেখানে এই জোটের সাথে আমাদের রণজাহাজ নিয়োজিত রাখার কোন মানে হয় না'।

এই মিত্র জোটে তুরস্কের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যে সাম্প্রতিকটি ঘটল ফ্রান্সকে ঘিরে। লিবিয়া নিয়ে ন্যাটোর অবস্থানকে ঘিরে এই উত্তেজনার আগে সিরিয়ার সঙ্কটে মধ্যস্থতা নিয়েও তুরস্ক আর ন্যাটোর প্রধান শরীক দেশগুলোর মধ্যে একই ধরনের মতবিরোধ দেখা গেছে। এই মতভেদ প্রকট হয় যখন বল্টিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা অনুমোদনের ব্যাপারে তুরস্ক এমনকী তাদের মতদান ঝুলিয়ে রাখে।

এরপর রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েও জোটের সাথে তুরস্কের মতভেদ হয়। এর ওপরে রয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ দেশ ও ন্যাটোর সদস্য গ্রিসকে নিয়ে ভূমধ্যসাগর এলাকায় আরও বিস্তৃত পরিসরে উত্তেজনার বিষয়টি।

জোটের কার্যপরিধির মধ্যে যেটা গ্রহণযোগ্য তুরস্ক সেই সীমা বারবার ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। তবে এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ মহামারির দিকে সব দেশের দৃষ্টি অনেকটাই সরে যাবার ফলে এবং ন্যাটোর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিকূল ও দ্বিমুখী একটা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও এই উত্তেজনা হয়ত প্রশমিত হবে বলেই আশা করা যেতে পারে।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িত দুই পক্ষের পেছনেই আন্তর্জাতিক সমর্থন আছে। তুরস্ক, ইতালি এবং কাতার ত্রিপলিতে এই মুহূর্তে শাসনক্ষমতায় আছে যে জিএনএ সরকার (গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশানাল অ্যাকর্ড) তাদের মদত দিচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমীরাত সমর্থন করে জেনারেল হাফতারকে।

ধারণা করা হয় যে, ফ্রান্সও জেনারেল হাফতারের সমর্থক, যদিও ফরাসী সরকার বারবার একথা অস্বীকার করেছে।

জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞায় লিবিয়াতে কোন সৈন্য মোতায়েন করা যাবে না এবং অস্ত্র পাঠানো নিষিদ্ধ। কিন্তু তা খুবই কম কার্যকর হয়েছে।

তুরস্ক ২০১৯ সালে জিএনএ সরকারের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে এবং জানুয়ারি মাসে দেশটিতে সৈন্য মোতায়েন করে।

গত মাসে জিএনএ বাহিনী অবশেষে ত্রিপলির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় যার পেছনে মূল কারণ ছিল তুরস্কের সহযোগিতা। জেনারেল হাফতার শহরের উপকণ্ঠ থেকে তার সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয় বলে খবর পাওয়া যায়।

মে মাসে ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয় যে, ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন পরিচালিত রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ থেকে কয়েক'শ সৈন্য লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের সমর্থনে কাজ করছে। বলা হয় ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আবার এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে এই ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সৈন্যরা লিবিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যদিও এই খবর নিশ্চিত করা যায়নি। সূত্র: বিবিসি

ঢাকা টাইমস/০৩জুলাই/একে