করোনার সঙ্গে বসবাস

সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন
| আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২০, ১০:২৮ | প্রকাশিত : ০৩ জুলাই ২০২০, ১০:২৭

বেশ ব্যক্তিগত একটা বিষয় আজ আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চাই। আমি অবশ্য একটু দ্বিধাগ্রস্তই ছিলাম এই বিষয়ে লেখার ব্যপারে। তবে আজ সকালে বন্ধু অমিতাভের কথায় মনে হলো, এই মূহুর্তে আখ্যান’টা বলে ফেলাই বোধহয় সবার জন্য মঙ্গলের।

১৭/১৮ দিন আগের কথা। হঠাত শুনি আমার একমাত্র শ্যালক, ক্যাসপারের গা এ গা এ একটু জ্বর এবং গলায় ব্যথা। বিকাল গড়াতে গড়াতে গলা ব্যথা’টা আরো বাড়ল। ততোক্ষণে ও আমাদের বন্ধু আদিলের সাহায্যে সালমা আদিল ফাউন্ডেশনের সহায়তায় টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ফিমার খালাতো বোনের বর বাবু কাজ করে রেনেটা’তে এবং ওর শ্বশুর বাড়িতে মোটামোটি সবারই করোনা হওয়ার কারণে ওর কাছে একটা সম্পূর্ন রেসিপি ছিল- কি কি ওষুধ শুরুতেই খেয়ে ফেলতে হবে এবং কি কি নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমি আর দেরি করলাম না টেস্টের রিপোর্টের জন্য। ড্রাইভারকে দিয়ে লিস্ট ধরে সব ওষুধ কিনে পাঠিয়ে দিলাম ওকে আর বললাম ওই রাত থেকেই খাওয়া শুরু করতে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো, নাহ! ওকে শান্তিনগরের বাড়িতে রাখা যাবে না। কারণ, আমার শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ি দুজনই বেশ বয়স্ক এবং অসুস্থ আর বাড়িতে ক্যাসপারের স্ত্রী এবং দুটো ছোট বাচ্চা আছে। তার মানে একদিকে আমার শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ির সংক্রমণের ভয় আরেক দিকে ওর স্ত্রী এবং ফুটফুটে দুটো বাচ্চার সংক্রমণের ভয়। সবচেয়ে বড় কথা ক্যাসপারের অসুখ’টা যদি বাড়াবাড়ির দিকে চলে যায়, তাহলে সামলাবে কে? আর চারিদিকে সবাই এতো নার্ভাস হয়ে আছে যে, মাথা ঠাণ্ডা করে হয়তো সময়মতো ঠিক সিদ্ধান্তই নিতে পারবে না। আমি আর দেরি করলাম না, ফিমাকে বললাম বেশি ভেবে সময় নষ্ট করা যাবে না, ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ আমার আর ফিমার কিংবা আমাদের সন্তানদের যা বয়স তাতে আমাদের মধ্যে সংক্রমণ হলে আমরা হয়তো সামলে নিতে পারব কিন্তু ফিমার বাবা-মা তা পারবেন না।

দুজনের অনেকক্ষণ বিতর্ক হলো- হয়তো এতক্ষণে ওর স্ত্রীর মধ্যে সংক্রমণ হয়েই গেছে, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মধ্যে ছড়িয়ে থাকতে পারে। আবার খবর নিয়ে দেখলাম যে ও যেহেতু কাজের কারণে রোজই বাইরে যাচ্ছিলো তাই বেশ কদিন ধরেই স্ত্রী, বাচ্চা এবং বাবা-মার সাথে একটা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছিল। খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম আমরা দুজন যে ওকে আমরা আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। এ কথা আমার শ্বশুর বাড়িতে জানাতেই আবার আরেকপ্রস্ত তর্ক-বিতর্ক।

এতদূর পথ আনতে গেলেই তো আর অনেক মানুষ সংক্রমিত হতে পারে, আর আসবেই বা কি করে, এমন আরো নানান প্রশ্ন। মাঝে আবার আলাপ হলো না হয়, শ্বশুর-শ্বাশুড়িকেই নিয়ে আসি আমাদের এখানে। কিন্তু তাতে সেই একই সমস্যা, ক্যাসপারের যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তখন কি হবে?! যাহোক শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ক্যাসঁপারকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হবে। ক্যাসপারকে বললাম তৈরি হয়ে নিতে আর ফিমার ড্রাইভার হিমুকে বললাম গাড়ি নিয়ে শান্তিনগরে ইষ্টার্ন পয়েন্টের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে এবং ক্যাসপার বের হলেই গাড়ির চাবি’টা ক্যাসপারকে দিয়ে বাসে করে চলে আসতে।

ক্যাসপার একবারে মাস্ক গ্লভস পড়ে গাড়ি চালিয়ে আমাদের পার্কিং এ গাড়ি রেখে ব্যাগ নিয়ে সোজা উপরে। আর ওইদিকে ফিমা আমাদের গেস্ট রুম’টা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলো এবং ওর আসবার খবর পেয়েই আমরা দরজা খোলা রেখে ভেতরে চলে গেলাম। ও সোজা বাড়িতে ঢুকে আগে দেওয়া ইন্সট্রাকশন মোতাবেক সোজা গেস্টরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফিমা একদম নিয়ম মেনে ওর জন্য ওর গ্লাস, গরম পানির ফ্লাস্ক, ওয়ান টাইম প্লেট সব তৈরি করে ফেললো। ব্যাস তারপর শুরু হলো ১৫ দিনের লড়াই করোনার সাথে।

পুরোটা সময় যোগাযোগ হলো মোবাইলে, খাওয়ার সময় আমি, রাজর্ষি কিংবা ফিমা ওয়ান টাইম প্লেটে সব খাবার নিয়ে রেখে আসতাম দরজার বাইরে। দিনে তিনবার করে দারচিনি, লঙ, এলাচি আর লবণ লেবু দিয়ে গ্রিন টি, বেশি করে ফল আর প্রোটিন জাতীয় খাদ্য- সব চলল। ওর যেন মন খারাপ না হয় তাই রোজ দুতিন বার করে ১০/১২ ফুট দূরে বসে আমি আর ফিমা মাস্ক পড়ে ওর সাথে আড্ডা মেরেছি, একসাথে বসে গান শুনেছি, মাঝে মাঝে রুচি পরিবর্তনের জন্য একটু বাইরে থেকে ব্রেকফাস্ট আনিয়ে খেয়েওছি। মাঝখানে ৮ম আর ৯বম রাতে ওর বেশ কষ্ট হয়েছিলো, তখন ওকে অনেক সাহস দেয়ার চেষ্টা করেছি আর সবসময়ই আমরা বাড়ির লোকজন এমন একটা ব্যবহার করেছি ওর সাথে যেন এটা কোন ব্যাপারই না, ভাইরাসকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই।

তারপর ১৪তম দিনে আবারো পরীক্ষা করানো হলো, ১৬তম দিনে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে, আমাদের সাথে এক টেবিলে বসে চা-নাস্তা খেয়ে, ওর ফুটফুটে দুটো বাচ্চা ওয়ানিয়া আর রুদাবার কাছে ফিরে গেছে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ওর স্ত্রী সবাই ভাল আছে। আর আমরা? আমরা তো ভাল আছিই, তা না হলে এতো রসিয়ে এই গল্প লিখলাম কি করে বলুন! শেষ কথা হচ্ছে, মানুষ করোনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। একটু নিয়ম মেনে চললেই হলো, ব্যাস!

লেখক: বিজ্ঞাপন লেখক, চলচ্চিত্রের কাহিনি রচয়িতা ও অভিনয়শিল্পী

(ঢাকাটাইমস/৭জুলাই/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :