৯৮ তম আন্তর্জাতিক সমবায় দিবসে একজন সমবায়ীর ভাবনা

তোফায়েল আহম্মদ
| আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২০, ১৫:০৩ | প্রকাশিত : ০৪ জুলাই ২০২০, ১৮:০৮

আজ জুলাই মাসের প্রথম শনিবার, আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস। এটি জাতিসংঘের ২৬ তম এবং আর্ন্তজাতিক সমবায় মৈত্রী সংস্থা (International Co-operatives Alliance) এর ৯৮ তম আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবস। জাতিসংঘ এবং আইসিএ ১৯৯৫ সাল থেকে আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবস যৌথভাবে পালন করে আসছে। ৯৮ তম আন্তর্জাতিক সমবায় দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে "Co-operatives for Climate Action" আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবসের এ দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি সমবায়ী ভাইবোনকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন ও শুভকামনা।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা বেড়েছে প্রায় ৫০% এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের জলবায়ু ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন ঘটার আশংকা সৃষ্টি হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। কিন্তু আমরা সেই নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে চাই। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার গুরুত্ব সম্পর্কে সমবায়ীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ বছর আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে যেটি জলবায়ু সম্পর্কিত সাসটেইনিবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) ২০৩০ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহঅবস্থানে থেকে সমবায় আন্দোলন মাধ্যমে জলবায়ু এজেন্ডাকে আমাদের দেশের অনুকূলে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করা এবং কোনো সম্প্রদায়কে পেছনে না রেখে সকল সম্প্রদায়ের জন্য একটি সবুজ ও সুন্দর পৃথিবী অর্জনের লক্ষ্যে International Co-operatives Alliance কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।

বর্তমানে দেশে ১ লক্ষ ৭৭ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে যার সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭৫০ জন। এটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬.৫০% ভাগ। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু প্রশ্ন???

হিমালয়ের পাদদেশে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত এ বদ্বীপ বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত কয়টি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে?

হাওড় এলাকার, শিল্প, কল কারখানা প্রধান এলাকার, পাহাড়ী এলাকার, নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার, খরা প্রবণ এলাকার, সুন্দরবন এলাকার, সমুদ্র পাড়ের নোনা জলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার, অধিক বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকার সমবায়ীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কয়টি সমবায় সমিতি গঠন করা সম্ভব হয়েছে?

ঐসব এলাকার উন্নয়নে সরকারি/বেসরকারি অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সেগুলোর সাথে সমবায় অধিদপ্তর কি কোন ভাবে লিংক করতে পেরেছে? না পারলে এর দ্বায় কার?

এ সংক্রান্ত প্রতিটি উপজেলা/জেলায় সরকার বিভিন্ন সংস্থা, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর এর মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তথা দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে সমবায় অধিদপ্তর এর ভূমিকা কি???

পরিবেশ দূষণ রোধে, সামাজিক বনায়নে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আধুনিক কৃষি ভিত্তিক সমবায় সমিতি কয়টি??

কৃষি সমবায় সমিতি, ভোগ্যপণ্য সমবায় সমিতি কয়টি কার্যকর?

বিদেশে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ,গ্যাস, সার সহ নানা ইনোভেটিভ আইডিয়া লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশেও কিছু সমবায় সমিতি নিজস্ব বায়োগ্যস প্লান্ট রয়েছে যা দিয়ে জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে কেচো কম্পোষ্ট জৈব সার উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এ রকম সমবায় সমিতি কয়টি????

ঐ উদ্যোক্তারা আদৌ সমবায় অধিদপ্তর থেকে কোনো সহযোগিতা পায় কি?

আমি যেধরনের সমবায় সমিতির কথা বলছি তারা কি আদৌ কোনো ঋণ সুবিধা বা সমবায় অধিদপ্তরের অন্য কোন সুবিধা পাচ্ছেন কি?

সমবায় সমিতি গুলো প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা সমবায় উন্নয়ন তহবিলে জমা দিচ্ছে। তার কতটুকু এ সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হচ্ছে? সমবায় অধিদপ্তর জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত কি কি প্রশিক্ষণ আয়োজন করেছে?

সমবায় ইউনিয়ন ও এর অধীনের সমবায় সমিতিগুলো কে কার্যকর করার কি উদ্যোগ সমবায় অধিদপ্তর নিয়েছে?

বর্তমান করোনা দুর্যোগে জলবায়ুর পরিবর্তন ইস্যু টি খুব ই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সমবায় অধিদপ্তর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা যদি একটু সচেতন হই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি, আসে পাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলে সবার জন্য মঙ্গল, এমনকি জলবায়ুর জন্য ও। তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরের আজকের পরিবেশ দেখুন। ঢাকার আবহাওয়া দেখুন। ..........

এ করোনা দুর্যোগে সমবায় অধিদপ্তরের বা সমবায়ীদের কি কি করণীয়????

১) যত শীঘ্র সম্ভব সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক করোনা দুর্যোগকালীন/জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

২) দ্রুত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

৩) অঞ্চল ভিত্তিক কর্মসূচী বা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

৪) হাওড়, পাহাড়ী, বন্যা কবলিত, সামুদ্রিক অঞ্চল ভিত্তিক সমবায়ীদের ডাটা বেস করতে হবে।

৫) রিসার্চ করে ঐ এলাকার নিড এনালাইসিস করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

৬) প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, জেলা উপজেলার ঐ সংক্রান্ত প্রকল্প বা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে এর সাথে সমবায় অধিদপ্তরের কিভাবে লিংক করা যায় মাঠ পর্যায়ে সে দিক নির্দেশনা দিতে হবে।

৭) করোনা দুর্যোগে যেহেতু সমবায়ী উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছে না, সীমিত পরিসরে বিক্রি করলেও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, সেহেতু সমবায় বাজার গুলো কার্যকর করে সমবায়ীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

৮) এ করোনা দুর্যোগে অনলাইন মার্কেটিং বা ই কমার্স সাইট কে উৎসাহিত করতে হবে। সমবায় অধিদপ্তর নিজে বা তার অধীন কোন সমবায় সমিতির মাধ্যমেও তা করতে পারে।

৯) এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের A2i প্রকল্পের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

১০) প্রয়োজনে কোনো বেসরকারি অন লাইন মার্কেটিং সংস্থার সাথে সমবায় সমবায় অধিদপ্তর বা এর কোনো সমবায় সমিতি যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে পারে।

১১) রেড জোনে বা লক ডাউন এলাকায় (বিভিন্ন এলাকায়) সমবায়ীদের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে ঐ এলাকায় নিবন্ধিত কোন সমবায় সমিতির মাধ্যমে ঐ এলাকার জনসাধারণের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সমবায় অধিদপ্তরের জাতীয় সমবায় মিল্কভিটা যেভাবে এ লক ডাউনে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করছে সেভাবেই অন্যান্য সমবায় সমিতিও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা সমবায় কার্যালয় কে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।

১২) যেসব হাউজিং সমবায় সমিতি রয়েছে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কোয়ার্টার বা হাউজিং বা এপার্টমেন্টে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

১৩) বিভিন্ন সমবায় সমিতির মাধ্যমে ছাদ কৃষির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

১৪) বিভিন্ন মহিলা সমবায়ীদের মাধ্যমে বিভিন্ন ফুড আইটেম তৈরি করে অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

১৫) সামনে কুরবানী ঈদের সময় কুরবানীর হাটে যাওয়া নিরুৎসাহিত করে সমবায়ী খামারীদের গরু অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে সমবায় সমিতির অনলাইনে কাস্টমার ছবি ও দাম দেখে গরু সিলেক্ট করে অর্ডার করবে, তারপর কুরবানীর সময় খামারী তার নিজ খামারেই গরু কুরবানী করে এর গোস্ত কাষ্টমারের বাসায় হোম ডেলিভারি পৌছে দিবে। এতে পরিবেশ ও নষ্ট হবে না, কাষ্টমারেরও বাড়তি ঝামেলা নেই।

১৬) এ করোনা দুর্যোগে সমবায় সমিতি গুলো তাদের সদস্য গণের যাকাত কেন্দ্রীয় ভাবে আদায় করে গরীব সদস্য বা এলাকার গরীব মানুষ গুলো কে দান করতে পারে।

১৭) প্রতিটি সমবায় সমিতি তার এলাকার জনসাধারণ কে সচেতন করার, এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে হবে।

১৮) প্রতি বছর সমবায় দিবসে পুরুষ্কার প্রদানের সময় পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সমবায় সমিতি ও সমবায়ীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

১৯) প্রতিটি গ্রামে একটি করে সমবায় সমিতি কে বায়োগ্যস প্লান্ট, কেচো কম্পোষ্ট সার সহ এ ধরনের পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে ঐ সমিতিকে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে।

২০) ঐ সংক্রান্ত কাজে "সমবায় উন্নয়ন তহবিল" থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২১) জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমবায় বান্ধব কর্মসূচী ও প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

২২) সরকারের জলবায়ু বিষয়ক ফান্ড থেকে বরাদ্ধ আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

২৩) করোনা দুর্যোগে সমবায় সমিতি ও সমবায়ীদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সমবায় সমিতি তে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে, অনেক সমবায়ী তাদের আমানত বা সঞ্চয় তুলতে পারছেনা...এসব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা উচিত। এ বিষয়ে সমবায় অধিদপ্তরের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বর্তমান করোনা দুর্যোগ মহামারী মোকাবেলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র সমবায় ই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা সবার সমন্বয় সাধন করে কমপ্রিহেনসিভ প্রোগ্রাম করে এ দুর্যোগ সফল ভাবে মোকাবেলা করতে পারে। কারণ প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জনবন বা সক্ষমতা সীমিত, কিন্তু সমবায়ের জনবল কোটি কোটি। সক্ষমতা ও সম্ভাবনা অসীম। তাই এ সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ এখন ই।

করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা এবছর এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করতে পারছি না। তবে প্রতি বছর আনুষ্ঠানিক ভাবে পালন করে ই বা কি অগ্রগতি হয়েছে? যদি সত্যিকার অর্থেই সমবায় শক্তির উপর আস্থা থাকে তাহলে এই দিবসের লক্ষ্য অর্জনে আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমি জানি বর্তমান সমবায় অধিদপ্তরের মাননীয় নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মহোদয় অত্যন্ত আন্তরিক ও দক্ষ সংগঠক। ওনার নেতৃত্বে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে সমবায় ও সমবায়ীরা। আন্তর্জাতিক সমবায় দিবসে আমি আবারও সমবায়ী ভাইবোনদের এটাই কামনা করি।

"জলবায়ুর পরিবর্তনে সমবায় নয়, সমবায়ী উদ্যোগে আমরাই নিয়ন্ত্রণ করবো জলবায়ুকে" এ হোক ভবিষ্যতের শুভ কামনা। ৯৮তম আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবস সফল হউক!

কৃতজ্ঞতায় ও তথ্যসূত্র : নিবন্ধক ও মহাপরিচালক আমিনুল ইসলাম

লেখক: উপ-নিবন্ধক ও অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক প্রশাসন বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লি. এবং কোষাধ্যক্ষ, ব্যবস্থাপনা কমিটি, ২৫ তম বিসিএস অফিসার সমবায় সমিতি লি.

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :