প্রসঙ্গ: বিসিএস

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২০, ১২:১১

আব্দুন নূর তুষার

জনাব আলী ইমাম মজুমদারের একটি লেখা পড়লাম প্রথম আলোতে। তার প্রতি সালাম ও শুভকামনা। এই করোনার সময়ে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থণা করি। এই রোগটি বয়োজ্যেষ্ঠদের বিষয়ে আমাদের অতিরিক্ত উৎকন্ঠায় ডুবিয়ে রেখেছে।

তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ মানুষ। অনেক পালক তার সাফল্যের ঝুলিতে। তারপরেও তার লেখার কিছু বিষয় অযৌক্তিক মনে হয়েছে। বিনীতভাবে এই বিষয়ে কিছু বলতে চাই।

প্রথমেই তিনি বলেছেন যে "একবছরেই বিসিএস এর সকল প্রক্রিয়া শেষ হবার কথা থাকলেও নানা কারনে সেটা হচ্ছে না।" এটা না হবার দায় অবশ্যই পিএসসিকে নিতে হবে এবং সরকারকেও এর জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এটা তিনি আর বলেন নাই।

তিনি বলেছেন একাধিক/দ্বৈত পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখা, ফল পেতে দেরি হবার একটি কারন। দ্বৈত পরীক্ষক দেবার কারন কি সেটা নিশ্চয়ই তার মনে আছে। বিসিএস এর প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে খাতা দেখায় নীতিহীনতার নানা অভিযোগ ছিল যার কারনেই দুজন পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখানোর অবতারণা। এই পরীক্ষার মান, প্রশ্নপত্রের মান, প্রশ্ন ফাঁস এসব , পুরো পি এস সিকে বিব্রত করেছে। তাই পরীক্ষার ফল দেবার সময় কমাতে পরীক্ষক আরো বাড়ানো হোক। একক পরীক্ষকের হাতে ফেরত যাওয়া মানে আবার শুণ্য বর্গক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন, ব্যাক টু গ্রাউন্ড জিরো।

তারপরই তিনি তার মূল বক্তব্যে চলে গেছেন ও নানারকম হিয়ারসে বা শোনাকথার ওপরে একটি বক্তব্য পেশ করেছেন। সাধারন শিক্ষা ও বিশেষায়িত শিক্ষা এই বিশেষনযুক্ত শিক্ষার নামকরনটিই প্রথমত আপত্তিকর। সাধারন শিক্ষা বলতে বোঝা উচিত সকল ছাত্র ছাত্রী যেসকল বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়েন। বাকি সবই আসলে বিশেষায়িত শিক্ষা। আমরা যখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় একটি বিষয় বেছে নেই তখনি আমরা সবাই বিশেষায়িত শিক্ষা পাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা কোনটাই সাধারন শিক্ষা নয়। ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বা ক্রিমিনোলজি কি সাধারন শিক্ষা? মোটেও না। এগুলোও বিশেষায়িত শিক্ষা।

বিশেষ শিক্ষায় সরকারের ব্যয় নিয়ে কথা বলাটাও, একটি বহুল ব্যবহৃত ভুল যুক্তি, যার সত্যতা এখন আর মেডিকেল শিক্ষায় খাটে না। দেশে সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনগুন বেশি। ছাত্রছাত্রীও বেশি। তারা সবাই নিজের পরিবারের পয়সায় পড়ে। তাছাড়া সরকারি মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের পেছনে সরকারের খরচ এখন অনেক কম।

সরকার সবচেয়ে বেশি খরচ করেছেন ২০১৫- ২০১৬-১৭-১৮-১৯ সালেও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চিকিৎসাবিদ্যায় এই ব্যয় অন্য অনেকের চাইতে কম। তাছাড়া চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের সরকার উচ্চশিক্ষার সময় সামান্য ভাতার বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করেন। বাইরে কোনো কাজ করার ওপরেও এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই সময়ে তিনি যদি একই যোগ্যতায় বাইরে কাজ করতেন তাহলে এর তিনগুন আয় করতেন। তাই হিসাব করলে দেখা যায় কেবল চিকিৎসকরাই তাদের ইন্টার্ন ও উচ্চশিক্ষাকালীন ন্যুনতম ভাতায় কাজ করে হ্রাসকৃত মূল্যে শ্রমের বিনিময়ে সরকারের টাকার প্রায় পুরোটাই ফেরত দিয়ে দেন।

তারচেয়েও বড় কথা হলো এই ব্যয়টি সরকার সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী করে থাকেন। এখানে এই ব্যয়কে পরবর্তিতে দরকষাকষির হাতিয়ার বানানোর কোনো কারন নাই। যার যা দরকার সরকার তাকে সেটাই দিয়েছেন এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ছাত্রীরা মেধার পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে এটা অর্জন করে। এটা কোনো দান খয়রাত না। এভাবে সরকার ধান চালেও ভর্তুকী দেয়। সেটা বিবেচনায় নিলে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব না যে সে সরকারের টাকায় প্রতিপালিত না।

তিনি সুকৌশলে বলে নিয়েছেন যে বাংলাদেশে মানম্পন্ন স্নাতক তৈরি হচ্ছে না। এটার সাথে বিসিএস পরীক্ষার আপাত কোনো সম্পর্ক নাই এজন্য যে, নির্দিষ্ট মান ছাড়া বিসিএসএ কৃতকার্য হওয়ায় যায় না। প্রয়োজনে পদ খালি থাকে। তাই শিক্ষার মান কমলেও মানহীন শিক্ষিতরা বিসিএসএ কৃতকার্য্য হয় না।

তিনি প্রিলিমিনারীতে বৈষম্য নাই বলেছেন। যে যুক্তিতে তিনি লিখিত পরীক্ষায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চেয়েছেন সেই একই যুক্তিতে প্রিলিমিনারীতে বৈষম্য আছে। প্রাথমিক নির্বাচনীতে বাংলা ইংরেজী বিজ্ঞান ও গনিত বাদে বাকি বিষয়গুলো হলো ইতিহাস, ভুগোল, সাধারন জ্ঞান। এই বিষয়গুলো মানবিক/ ব্যবসা/ বিজ্ঞান শাখায় সবাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে আবশ্যিক হিসেবে পড়ে না। অতএব এই প্রিলিমিনারী পরীক্ষাতে সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিন্তু থাকে না।

তিনি এরপরে বলার চেষ্টা করেছেন যে আগের চাইতে বেশি পরীক্ষার্থী বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিসিএস পরীক্ষায় তাদের নিজেদের পড়ার সাথে সম্পর্কিত চাকরিতে না গিয়ে সাধারন বিসিএসএ কৃতকার্য্যতা সাপেক্ষে পুলিশ, প্রশাসণ, পররাষ্ট্রে যোগ দিচ্ছেন। এটা কেন হচ্ছে সেসব কোনো কিছুতে বিশদ কোনো আলোচনায় না গিয়ে তিনি সরাসরি বিসিএস পরীক্ষার বিষয় ও পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা বলেছেন। যেন এটা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

১. বিসিএসএ প্রশাসনিক পদে ডাক্তার প্রকৌশলী কৃষিবিদ আসলে সমস্যা কি?

 

মেধাবী মানুষ যেখানেই যাক তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সহজ হবার কথা। তিনি এখানে সমস্যা হিসেবে একটা বিষয়ই উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্র নাকি তাদের অর্থ দিয়ে প্রতিপালন করে শিক্ষা দেয়। এটা যে সঠিক নয় সেটা একটু আগেই আপনারা জেনেছেন। রাষ্ট্র সবার পেছনে টাকা দেয় বরং বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারি ব্যবস্থার চাইতে বড় হয়ে যাওয়ায় এখন বেসরকারি ছাত্র ছাত্রী বেশি। ফলে এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে সেটা হবে অযৌক্তিক কারন অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী এখন নিজের পয়সায় পড়ে।

 

২. পরীক্ষার বিষয় বদলে দিলে কি লেভেল প্লেয়িং হবে?

 

মোটেও না। পরীক্ষার বিষয় বদল করলে বরং চিকিৎসক প্রকৌশলী কৃষিবিদদের কেবল আটকানোর লক্ষ্যেই সেটা করা হবে। সেটা হবে আনইভেন প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার চেষ্টা।

 

৩. বিশেষায়িত শব্দটা কি ঠিক?

 

মোটেও ঠিক না। কারন যিনি সাংবাদিকতা পড়েন, লোক প্রশাসনে পড়েন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়েন তিনিও বিশেষ শিক্ষাই পেয়েছেন। তাকে সাধারন শিক্ষা বলার কোনো যুক্তি নাই।

 

৪. সমস্যা কোথায়?

 

সমস্যা হলো সরকারি চাকরিতে বিরাট ক্যাডার বৈষম্য আছে। চাকরির পদ , পদোন্নতি, সরকারি সুবিধাদি, প্রশাসনিক ক্ষমতা একেক ক্যাডারে একেক রকম। একই ব্যাচে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে পদোন্নতি হয় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। কেউ মোবাইল গাড়ি খানসামা সব পায় , কেউ সারা জীবন গাড়ি তো দূরের কথা, ঠেলাগাড়িও পায় না।

চাকরি ক্ষেত্রে এই বৈষম্য নিয়ে আলী ইমাম মজুমদার সাহেব নীরব। পড়ালেখায় সারাজীবন এগিয়ে থেকে মেডিকেল ক্যাডারে গ্রেড - ১ পদে পদোন্নতি হবার সম্ভাবনা মঙ্গল গ্রহে পা রাখার সম্ভাবনার চেয়ে কম।

কৃষি , স্বাস্থ্য , বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কৃষিবিদ, চিকিৎসক বা শিক্ষকের সচিব বা ন্যুনতম সহকারী সচিব হবারও কোনো সুযোগ নাই বললেই চলে।

লোকপ্রশাসণে পড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বোঝা যায় কিন্তু চিকিৎসা পড়লে প্রশাসণ বোঝা যায় না, এই মানসিকতা থেকে সরে আসা দরকার। ইচ্ছাকৃতভাবে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সময়ও তথাকথিত “বিশেষ”দের জন্য আলাদা সময়কাল ঠিক করা ছিল। একসময় সেটা পেতে বহু দেরি হতো বলে চাকরি স্থায়ীকরণ হতে দেরি হতো চিকিৎসকদের।

 

৫. কেন তবে এই পরীক্ষা বদলের দাবি?

 

কারন একটাই , বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিতরা প্রশাসনে চলে এসেছে, পররাষ্ট্রে চলে এসেছে। এই লেখাটিও তাই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা বলেই প্রতীয়মাণ হচ্ছে। যারা টিকেছে তারা মেধার কারনেই টিকেছে। বিসিএস পরীক্ষায় মেধাবীরা যে যার খুশি মতো চাকরি নির্বাচন করলে রাষ্ট্রের লাভ। এখানে ডাক্তার কর কর্মকর্তা হলে দু:খ না পেয়ে বরং ডাক্তারি পড়া কাজে লেগেছে ভাবা উচিত। নইলে বাংলায় প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত কাস্টমসের কর্মকর্তা হলেও ভাবতে হবে বাংলায় পড়া কোন কাজে লাগলো না।

 

৬. সমস্যার সমাধান কি?

 

সমস্যার সমাধান হলো আন্ত: ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ। সকল ক্যাডারের জন্য সমান বেতন, সমান সুবিধা, একই সময়ে পদোন্নতির লক্ষ্যে সরকারি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। বিশেষ যদি কেউ হয়েই থাকে তবে তার সুবিধাদি বিশেষ হওয়া দরকার। তার জন্য বরং ঝুঁকিভাতা, প্রণোদনা থাকা দরকার। অথচ ঘটে ঠিক তার উল্টোটা। বিশেষদের কর্মজীবনে হতাশার কারন চিহ্নিত করে সকল সমস্যা দুর করা প্রয়োজন। মেধার মূল্য দেওয়া দরকার।

জনাব আলী ইমাম মজুমদার সম্মানিত ব্যক্তি ও বিদ্বানও বটে। কিন্তু ইংরেজীতে “বায়াস” বলে একটা শব্দ আছে। পূর্বনির্ধারিত মন নিয়ে যে লেখাটি তিনি লিখেছেন , এই লেখাটিতে “বায়াস” বা পক্ষপাত আছে। এই পক্ষপাত বহুবছরের ঔপনিবেশিকতার ফসল। এখানে সরকারি চাকরিতে সকলে সমান তবে কেউ কেউ একটু বেশি সমান ভাবার অবকাশ আছে।

লেখাটিতে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নামক বহুল ব্যবহৃত রাজনৈতিক শব্দটি ব্যবহার করে সরকারি চাকরিতে যোগ্যতা সাপেক্ষে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের যে অধিকার, সেই অধিকারকেই ক্ষুন্ন করার চেষ্টা আছে। এতদিন মনে হলো না পরীক্ষা লেভেলে নাই, হঠাৎ এবার মনে হলো কেন? কারন এবার যে ক্যাডারগুলোকে উচ্চশ্রেণির বলে মনে করা হয় সেখানে তথাকথিত বিশেষায়িতরা উচ্চমাত্রায় প্রবেশ করেছে বলে ধারনা করা হয়েছে। এই বেশি কম মানসিকতাটাকে অসম আচরণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারন আছে।

এই লেখাটি লেভেল পরীক্ষা চেয়েছে কিন্তু লেখাটি নিজেই লেভেল না থেকে একদিকে কাত হয়ে পড়েছে।

লেখক: চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

ঢাকাটাইমস/জুলাই/এসকেএস