স্বামীর জন্য দোয়া চাইলেন শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২০, ১৫:১৯ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২০, ১৫:২৭

রাজশাহী ব্যুরো, ঢাকাটাইমস

সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেওয়ায় প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে ক্যানসার নিয়েই দেশে ফিরতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি রাজশাহীতে আছেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। রবিবার রাতে এন্ড্রু কিশোরের ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক পোস্টের মাধ্যমে স্বামীর জন্য দোয়া চেয়েছেন তার স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু।

পোস্টে লিপিকা জানান, গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর তারা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। সেখানে এন্ড্রু কিশোরের ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। চিকিৎসক বলেছিলেন, এখন আর কিছু দরকার নাই। ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন, আগস্ট মাসে যেতে। তারা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকিট কাটেন। কিন্তু কিশোর শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিলেন। তাই ওই টিকিট বাতিল করা হয়। চিকিৎসক বলেন, কেমোর জন্য এন্ড্রু কিশোর দুর্বল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবেন, সময় লাগবে।

পরে ১০ জুন তারা আবার টিকিট কাটেন। কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে। পরদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তাই ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোন ওষুধ তার শরীরে কাজ করছিল না। চিকিৎসক বলেছিলেন, ক্যানসার আবারও আসছে কিনা তা দেখতে হবে। পরীক্ষার পর দেখা যায় এন্ড্রু কিশোরের শরীরে সেটিই ঘটেছে।

পোস্টে লিপিকা লেখেন, ‘চিকিৎসক আমাকে ফোন করে বলেন, পেট স্ক্যান করতে হবে। লিম্ফোমা ব্যাক করেছে কিনা দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে চিকিৎসক বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি আবার আসে। তাহলে সেটা ডাবল স্ট্রং হয়ে আসে আর খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সেটা কোনভাবেই কন্ট্রোল সম্ভব হয় না।

৯ জুন পেট স্ক্যান হয়। সেদিন রাতে চিকিৎসক আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন সকাল ১০টায় আমার সঙ্গে রিপোর্ট নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান তিনি। ওই রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। সকাল ১০টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে। কিশোর আমাকে বলল, চিকিৎসককে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরব। আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি। শুধু বললাম, দেখি চিকিৎসক কি বলে। এরপর চিকিৎসক লিমের সঙ্গে দেখা হলে তিনি একটাই কথা বললেন, লিম্ফোমা ব্যাক করেছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোন কথা বলতে পারছিলাম না, বুঝলাম সব শেষ।

চিকিৎসক বললেন, এন্ড্রুকে বলব ? আমি বললাম, বলতে তো হবে। তিনি আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নিয়ে দেখালেন, এড্রিনাল গ্ল্যান্ডে কিছু নাই। কিন্তু লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে চিকিৎসককে বললাম হোয়াট নেক্সট?

তিনি বললেন, আই অ্যাম স্যরি। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এরপর বিষয়টি কিশোরকে জানানো হলে সে বলে ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না, আমি কাল দেশে ফিরব। আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না। তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। কিশোর হাইকমিশনে ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার প্লেন ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।

কিন্তু ঈশ্বরের কি খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম। অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন? তিনি জানান, ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন। তবে সাধারণত মাস থেকে বছর।

এখন কিশোর কোন কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কি ভাব? সে বলে, কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।’

লিপিকা তার পোস্টে আরও লেখেন, ‘ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন। যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হল, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত স্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’

এ ব্যাপারে এটা শেষ পোস্ট উল্লেখ করেন তিনি লেখেন, ‘এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়। কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকব। মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে সবাই সাবধানে থাকবেন। নিজের প্রতি যত্ন নেবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন। আর এন্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন। প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’

রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া এন্ড্রু কিশোর ১৯৭৭ সালে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্লেব্যাকে যাত্রা শুরু করেন। এরপর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। তার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ‘গো ফান্ড মি’ নামে এক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। সহশিল্পীদের মধ্যেও অনেকে তার পাশে দাঁড়ান। কিন্তু চিকিৎসায় তার সুস্থতা আসেনি। বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই শিল্পী এখন চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।

ঢাকাটাইমস/৬জুলাই/পিএল