জাপানে করোনা প্রতিরোধের সাফল্যে নৈতিক শিক্ষার অবদান

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২০, ১৯:১৯ | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০, ২০:১৮

ড. মো. মনির উদ্দিন

জাপানে করোনা মহামারী প্রতিরোধে সাফল্যের খবর এখন সকলেরই জানা। অনেকের কাছে এ সাফল্য বিস্ময়করও বটে। কারণ, একমাস আগেও বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জাপানে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছিলেন।

জাপানি নাগরিকদের মধ্যেও সরকারের করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে একরকম অসন্তোষ বিরাজ করছিল। হঠাৎ করোনা সংক্রমনের ব্যাপক ঊর্ধবমুখী প্রবণতাও সরকারকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।

যদিও এই লেখকের জাপানি সমাজের অন্তর সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকায়, কেন যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে─ জাপান এটি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে না। যাইহোক, জাপান বিস্ময়করভাবে একটি অভাবনীয় বিপর্যয় থেকে অতি অল্পতেই রক্ষা পেলো। আর রক্ষা পাওয়ার পেছনে অনেক অবদান থাকলেও সিংহভাগ অবদান জাপানি নাগরিকদের নৈতিক শিক্ষার।

জাপানে প্রথম করোনা সনাক্ত হয় জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। মার্চের ২৭ তারিখ করোনা সনাক্ত রোগীর সংখ্যা একহাজারেরও কমছিল। কিন্তু মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে সংক্রমিত রোগী শনাক্তের সংখ্যা ব্যপকহারে বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে সংখ্যাটি সাড়ে তিন হাজার অতিক্রম করে। জাপান সরকার ৮ এপ্রিল অপেক্ষাকৃত বেশি সংক্রমিত ৭টি প্রিফেকচারে এবং ১৬ এপ্রিল দেশের অন্য ৪০টি প্রিফেকচারেও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।

জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাফল্যও আসে খুব দ্রুত। অতিদ্রুত সংক্রমণ কমতে থাকে। যেখানে ১১ এপ্রিল ১দিনে সনাক্ত রোগী ছিল (সংক্রমনের সর্বোচ্চ চূড়ার দিন) ৭৪৩, সেখানে ১১ মে অর্থাৎ চূড়ায় ওঠার একমাসের মধ্যে ১দিনে এ সংক্রমন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৭০-এ। তার পর থেকে দিনে সংক্রমনের সংখ্যা ১৪ থেকে ১৩০ (জুলাই ১) এর মধ্যে আছে। নাগরিক জীবন অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার ফলে সামান্য বৃদ্ধির প্রবণতা থাকলেও বিচলিত হওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি জাপানে এখনো তৈরি হয়নি; আর, আশা করি তা হওয়ার আশংকাও নেই।

এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে জাপান এতদ্রুত এই সাফল্য পেলো কীভাবে? এই উত্তরটি পাওয়ার আগে প্রয়োজন জাপান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং সেই পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা।

করোনা সংক্রমনের প্রথম দিকে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে ফেব্রুয়ারি, এমনকি মার্চ মাসেও জাপান সরকার নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ করে। এখানে মনে রাখতে হবে আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকার কারণে জাপান সরকার তার নাগরিকদের কেবলমাত্র অনুরোধ করতে পারে বা পরামর্শ দিতে পারে।

বিশেষভাবে সরকার নাগরিকদের মাস্ক পরতে অনুরোধ করে এবং জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়। জনগণও যথারীতি মাস্ক পরিধান করে, যদিও জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার বিষয়ে কিছুটা ব্যত্যয় দেখা যায়।

অপরদিকে ক্লাস্টারভিত্তিক নমুনা পরীক্ষা করে  করোনা আক্রান্তদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। সংক্রমন বাড়তে থাকলে জনগণকে যতোটুকু সম্ভব বাড়িতে থেকে অনলাইনে অফিসের কাজ চালিয়ে যেতে অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে জনাকীর্ণ স্থান বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে অনুরোধ করে সরকার।

যথারীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও অনেক জনাকীর্ণ স্থান বিশেষ করে পানশালা, গেইম সেন্টার, ক্লাব, এসব জনাকীর্ণ স্থানগুলো প্রত্যাশিতভাবে বন্ধ না হওয়ায় সংক্রমণ বাড়তেই থাকে। সাংবাদিকরাও প্রধানমন্ত্রী আবের কাছে জানতে চান  জরুরি অবস্থা ঘোষণার মতো পদক্ষেপের বিষয় সম্পর্কে।

একটি উচ্চ পর্যায়ের করোনা ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে পরামর্শ পাওয়া প্রধানমন্ত্রী  উত্তরে সাংবাদিকদের জানান─ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দেখতে চান। অবশেষে মূলত জনাকীর্ণ স্থানগুলো পুরোপুরিভাবে বন্ধ না হওয়ার কারণে এপ্রিলের প্রথম দিকে যখন সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়তে থাকলো। তখন এপ্রিলের ৮ তারিখে ৮টি প্রিফেকচারে এবং এপ্রিলের ১৬ তারিখে বাকি ৩৯টি প্রিফেকচারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।

জাপানের এই জরুরি অবস্থার অর্থও আমরা হয়তো ভুল বুঝতে পারি। যেমন বাংলাদেশে লকডাউনকে জরুরি অবস্থার চেয়ে কোমল মনে করা হয়। আর জরুরি অবস্থাকে মনে করা হয় লকডাউনের চেয়েও কঠোর। তাই বাংলাদেশে অনেকেই জরুরি অবস্থা ঘোষণার অর্থ হিসেবে অনেক বেশি কঠোর অবস্থাকে মনে করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতাটা হলো একে বারেই উল্টো। জাপানে ইউরোপের মতো লকডাউন আইনসিদ্ধ নয়। আবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা গেলেও তা কেবলমাত্র নাগরিকদের পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করানোর জন্য। কারণ জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের কোনো নির্দেশ দিতে পারে না।

তাই প্রধানমন্ত্রী আবে নাগরিকদেরকে বাসা থেকে বের হওয়ার বিষয়ে সংযম প্রদর্শন (জিশুকু) করতে অনুরোধ করেন। অর্থাৎ বাসা থেকে বের না হতে অনুরোধ করেন। অপরিহার্য কারণে যাদের বাইরে যেতে হবেই কিংবা যারা বাসায় থাকবে তাদের সকলকেই তিনটি বিষয় এড়িয়ে চলতে বলা হয়─ অবাদ বায়ু প্রবাহ নেই এরকম বদ্ধ জায়গা, জনসমাগমের স্থান এবং অন্য বাক্তির খুব কাছে যাওয়া। এবং একইসঙ্গে বের না হওয়ার সম্ভাব্য ফলাফলে হিসেবে বলা হয়─ যদি ৮০ ভাগ নাগরিক এই আত্মসংযম প্রদর্শন করেন অর্থাৎ নাগরিকদের চলাচল যদি ৮০ভাগ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে করোনা সংক্রমন খুব দ্রুত কমে যাবে।

নাগরিকেরা প্রধানমন্ত্রী ও প্রিফেকচার গভর্ণরদের অনুরোধে সাড়া দেন। তারা সাধ্যমত স্ব-স্ব আবাসস্থলে অবস্থান করতে থাকেন। জনাকীর্ণ স্থানগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। যদিও সকল অফিসিয়াল ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ড সীমিত আকারে চালু থাকে। অতিদ্রুত সংক্রমন কমে আসায় ১৮মে সরকার ৮টি প্রিফেকচার বাদে অন্য ৩৯টি প্রিফেকচার থেকে ২১মে আরো ৩টি প্রিফেকচার এবং ২৫মে সর্বশেষ ৫টি প্রিফেকচার (টোকিও, হোক্কাইডো, সাইতামা, চিবা, কানাগাওয়া) থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়।

এপর্যন্ত জানার পর জাপানের এই সাফল্যের কারণ হিসেবে সকলেই কিছু না কিছু বলতে পারবেন। হ্যাঁ, এই সাফল্যের জন্য, সরকারের সঠিক নীতির, স্বাস্থ্যবিষয়ক জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা প্রভৃতি বিষয়গুলো উল্লেখ করা যেতেই পারে। অথবা বলা যেতে পারে─ এটি ছিল বহুপক্ষীয় প্রচেষ্টা ও পাস্পরিক সহযোগিতার সাফল্য।

তবে এখানে এই সাফল্যের প্রধান কারণ হিসেবে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। তা হলো জাপানি নাগরিকদের নৈতিক শিক্ষার প্রায়োগিক চর্চা। আলোচনাটি শুরু করতে চাই টোকিও মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রিউজি কোইকের মন্তব্য দিয়ে।

রিউজি কোইকে বলেন, “আমি মনে করি না সরকারের নীতির কারনে সংক্রমন কমছে। দেখে মনে হচ্ছে জাপান ভালোই করছে, আর সেজন্য ধন্যবাদ এমন কিছু জিনিসকে যা আসলে মাপা যায় না, যেমন জাপানিদের দৈনন্দিন জীবনাভ্যাস ও আচরণ”।

জীবনাভ্যাসের কথা যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে জাপানিরা অত্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে তারা সবসময়ই সচেতন, জাপান সর্বোচ্চ গড় আয়ুর দেশ হলেও এদেশে স্থুল মানুষের সংখ্যা খুবই কম। জাপানি নাগরিকেরা শুভেচ্ছা বিনিময়ে একে অপরকে স্পর্শ করে না, অর্থাৎ হাত মেলানো বা কোলাকুলি করে না। বরং দূর থেকে মাথা নিচু করে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। জাপানিদের এই দূরত্ব রক্ষা করে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ফলে সংক্রমনের সম্ভাবনাও কম থাকে।

তাছাড়া আরেকটি বিষয় হলো জাপানিদের মাস্ক পরিধানের পুরনো অভ্যাস। এটি জাপানি নাগরিকদের সাধারণ অভ্যাস। অর্থাৎ কারো সামান্য ভাইরাল জ্বর বা একটু ঠান্ডা লাগলেও তারা বাইরে এমনকি ঘরেও মাস্ক ব্যবহার করে থাকে। আর এই সংক্রমনের প্রথম দিক থেকেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জাপানিদের জীবনাচারে যে বিষয়গুলো ইতোমধ্যেই উপস্থিত সেসব বিষয়ে বলছিল─ শারিরীক দূরত্ব (সামাজিক দূরত্ব), মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়া।

জনাব কোইকে হয়তো এসব বিষয়গুলোর দিকেই ইংগিত করেছিলেন। তবে, তার চেয়েও আরো অনেক গভীরভাবে এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন জাপানের আরেকজন বিশিষ্ট নাগরিক (তাঁর ইচ্ছায় নাম উল্লেখ করা হলো না; তবে তার রেফারেন্স ব্যবহারের বিষয়ে লেখককে অনুমতি নেয়া হয়েছ)। এই বিশিষ্ট নাগরিক গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (IOM) উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার (তিনিও একজন জাপানি নাগরিক) কাছে জাপানি ভাষায় লেখা ইমেইলে জাপানে করোনার প্রভাব প্রসঙ্গে এভাবে লিখেন- জাপানি ধরনের আত্মসংযমের মাধ্যমে এতোটুকু ক্ষতিতে সারতে পারাটা হলো, জাপানি জাতির <অন্যকে সমস্যায় ফেলা উচিৎ নয়> এই নৈতিকতা বোধের অহংকার (日本流の自粛という形で、この程度の災害で済ませる事が出来ている事は、我々民族が「他人に迷惑を掛けてはならない」との道徳心の誇りです)।

বর্তমান লেখক তার জাপানে অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা, একাডেমিকভাবেও জাপানের সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়নের জ্ঞান এবং তার নিজের সন্তান জাপানের স্কুলে অধ্যয়নকালীন পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে উক্ত মন্তব্যটি ব্যখ্যা করার চেষ্টা করবে।

জাপানি সংস্কৃতিতে <অন্যকে সমস্যায় ফেলা উচিৎ নয়/অন্যকে বিরক্ত করা উচিৎ নয়> এই নৈতিক শিক্ষা ও তার চর্চা শিশুর ২ থেকে ৩ বছর বয়স থেকে শুরু হয়। জাপানে শিশু বিদ্যালয়গামী হওয়ার পূর্বে পরিবার থেকেই তাকে এই শিক্ষা দেওয়া হয়।

চার বছর বয়সে সে যদি কিন্ডারগার্টেনে বা আরো কম বয়স থেকে সে যদি দিবা পরিচর্যা কেন্দ্রে যায় সেখানেও তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বাস্তব চর্চার মাধ্যমে এই শিক্ষাটি দেওয়া হয়। ছয় বছর বয়সে শিশু যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে, তখন সে হয়তো প্রতিদিনই এ কথাটি শুনতে থাকে এবং বাস্তবে তা মানতে থাকে। আস্তে আস্তে তার চলাফেরার পরিসর প্রশস্ত হয়; সেখানেও সে একই কথা শুনে এবং সে অনুযায়ী তা মেনেও চলে।

এই যে <অন্যকে সমস্যায় ফেলা উচিৎ না/বিরক্ত করা উচিৎ না> এই নৈতিক শিক্ষার পরিধিই বা কতটুকু! এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই শিক্ষাটি কার্যকর। ট্রেনে একজন লোককেও উচ্চ স্বরে কথা বলতে দেখা যাবে না। কারণ তাতে অন্যের অসুবিধা হতে পারে। রস্তায় ময়লা ফেলা যাবে না, কারণ তাতে অন্যের সমস্যা হবে। পরিবারের মধ্যেও কাজের বন্টন করে কাজ করতে হবে, অন্যের ওপরে কাজের চাপ কমাতে। ঠান্ডা লেগেছে বাইরে মাস্ক পরে যেতে হবে, কারণ অন্যের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। রাস্তায় চিৎকার চেচামেচি করা যাবে না, কারণ অন্যের সমস্যা হতে পারে।

মানুষ তার জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অন্যকে সমস্যায় ফেলা উচিৎ হবে না বা বিরক্ত করা উচিৎ হবে না এই বিবেচনাটি মাথায় রেখে চলবে। আর এই বিবেচনার প্রয়োগটা হলো সংযমে। অর্থাৎ বিবেচনা করে যা বুঝবেন সে অনুযায়ী আপনি আচরণগতভাবে সংযমী হবেন। এবারের করোনা মহামারীর সময়ও জাপান সরকার সংযম (জিশুকু) নামক কৌশলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

আপনি যদি বাড়ি থেকে বের হন তাহলে আপনি আক্রান্ত হবেন, তাতে আপনি যেমন দুঃখ ভোগ করবেন, আপনার পরিবারও তেমনি দুখ ভোগ করবে। অথবা আপনার কারণে আপনার পরিবার সংক্রমিত হবে। অতএব আপনার বাইর হওয়াটা অন্যের কষ্টের কারণ হবে, এই বিবেচনায় আপনি বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সংযমী হোন, একই বিবেচনায় আপনি মাস্ক পরিধান করুন, একই বিবেচনায় আপনি জনবহুল স্থানে যাবেন না, প্রভৃতি। আর এই বিবেচনার প্রয়োগটি এবার জাপানকে অনেক বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা হচ্ছে; তবে জাপানের ব্যাপারে শংকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ তার রয়েছে এক অনন্য ক্ষমতা “অন্যকে সমস্যায় ফেলা উচিৎ না” নামক নৈতিক শিক্ষার ক্ষমতা। ভুলে গেলে চলবে না যে জাপান একটি গোষ্ঠিতান্ত্রিক সমাজ। এখানে ব্যক্তিতান্ত্রিক বলতে কিছু নেই। ব্যক্তি এখানে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করবে না চিন্তা করবে গোষ্ঠীকে নিয়ে। আর ব্যক্তিকে নিয়ে চিন্তা করার দায়িত্ব গোষ্ঠির।

পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিক তো দুরের কথা রাষ্ট্রের প্রধানদেরও মাস্ক পরিধানে অনীহা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তারা অন্যের বিষয়ে ভাবতে চান না; তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী, শুধু নিজের কথা ভাবেন, নিজের স্বাচ্ছন্দকে প্রাধান্য দেন। যেমন জাপানে অবস্থানরত আমেরিকার এক সাংবাদিক কোনোভাবেই মাস্ক পরতে চাচ্ছিলেন না। পরে অবশ্য পরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

প্রশ্ন জাগতেই পারে বাংলাদেশে তো নৈতিক শিক্ষা কম দেওয়া হয় না; তা হলে এখানে মানুষ সরকারের নির্দেশনা মানছে না কেন? নিজের কারণে অন্যের ক্ষতি হতে পারে এটি মানুষ বিবেচনায় নিচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের শিক্ষা অনেকটা সেই “কিতাবে লেখা আর গোয়ালে না থাকার” মতো।

মূলত একটি ঐকতানিক শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে এখনো একটি ‘মান সমাজ’ গড়ে ওঠেনি। এই সমাজটি না পশ্চিমা ব্যক্তিতান্ত্রিক না জাপানের মতো গোষ্ঠীতান্ত্রিক। যদিও যথেষ্ট পরিমানেই পরিবারতান্ত্রিক। “অন্যকে সমাস্যয় ফেলা উচিৎ নয়/বিরক্ত করা উচিৎ নয়” যেটি জাপানিরা বলে থাকেন─ তানিন নি মেইওয়াকু কাকেতেওয়া ইকেনাই। এই বিবেচনা বোধটি বাংলাদেশের সমাজে চর্চিত হলে জাতির জীবনাচরন অনেকটাই বদলে যেতে পারতো। এখনও চর্চাটি শুরু করলে ধীরে হলেও সেই বদল আসতে থাকবে।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়