করোনায় মানসিক উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক মনিরা পারভীন

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ০৯:৫৮

মো. শাহিন রেজা, শিক্ষক

লেখাটা শুরু করবো মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন- "A good teacher is like a candle, its consume itself to light the way for other's". আজ এমনই একজন শিক্ষকের গল্প বলবো যিনি মানসিক ভাবে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত একজন অসাধারণ শিক্ষক। করোনা দুর্যোগে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন মানবসেবায়। বলছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের প্রভাষক, মনিরা পারভীনের কথা।

 খুলনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনা বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) পড়াশোনা শেষ করে, ভারত সরকারের আই.সি.সি.আর. কতৃক বৃত্তি নিয়ে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০০৯-১৪) নৃত্য বিভাগ থেকে এমএ (প্রথম বিভাগে প্রথম), স্নাতক (প্রথম বিভাগে দ্বিতীয়) স্থান অর্জন করেন। এমএ এর সাফল্যের কারনে তিনি ২০১৪ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার কেশশ্রী নাথ ত্রিপাঠী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সভ্য সাচী বসু রায় চৌধুরী এর কাছ থেকে সমাবর্তনে স্বর্ণপদক ও বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন।

এর আগে ১৯৯৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি নৃত্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন মোস্তাক সেলিম পপলু-এর কাছে খুলনা উদীচীতে। ২০০৪-০৯ সাল পর্যন্ত কত্থক নৃত্যে তামিল নিয়েছেন শিবলী মোহাম্মদ ও সৃজনশীল নৃত্যে শামীম আরা নীপা-এর তত্ত্বাবধানে। ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় জাতীয পর্যায়ে " আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়" কত্থক ও সৃজনশীল নৃত্যে দুইটি স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি নিয়মিত বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলা ভিশন, এনটিভি, এসএটিভি, এটিএন, চ্যানেল আই, মাছরাঙা, যমুনা টিভি, বৈশাখী টেলিভিশন ও আরটিভি সহ বিভিন্ন চ্যানেলে নৃত্য পরিবেশনা করছেন।

রবীন্দ্রভারতী থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন।  তিনি একাধারে শিক্ষক ও নৃত্যশিল্পী। শিক্ষকতা ও নৃত্যের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গবেষণা, সেমিনার ও দেশ-বিদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নৃত্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহন করছেন। লেখালেখি কাজেও তিনি নিজেকে  নিয়োজিত রেখেছেন সবসময়। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ "বাংলাদেশের নৃত্যকলার ত্রিধারা" বাংলাদেশ উপ-হাইকমিন কলকাতা আয়োজিত, "বৈশাখী বৈশাখ" -১৪২০ এ প্রকাশিত হয়।

ছোট বেলা থেকেই তিনি নাচের অনুশীলন করতেন। ১৯৯৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধ্রুব পরিষদ আয়োজিত পাঁচ বছর মেয়াদ নৃত্য প্রশিক্ষনে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন। করেছেন নৃত্যের উপর তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স নৃত্যাঞ্চল থেকে। জাবিতে পড়া অবস্থায় তিনি জাবির মুক্ত মঞ্চ কাপিয়েছেন এক সময়।

তার সৃজনশীল কর্মকান্ড, নৃত্যের অসাধারণ উপস্থাপন, সহনশীলতা, সহমর্মিতা দিয়ে জয় করেছিলেন বিভাগ, হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,  ব্যাচমেট, জুনিয়র ও সিনিয়রদের মন।

শিক্ষক হিসাবেও তিনি বর্তমানে মহত্ত্বের পরিচয় দিচ্ছেন। সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীবৃন্দ ভর্তি হয়। করোনা দুর্যোগে হল বন্ধ থাকায় তাঁরা সবাই এখন বাড়ীতে। কেউবা দূর্বিসহ জীবনযাপন করছে। ঠিক এই মুহূর্তেই অকৃত্রিম ভালোবাসা ও স্নেহের পরশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কারন, করোনা কালে ছাত্র/ছাত্রীদের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর মনকে খুবই ব্যথিত করছে।

তার মতে, 'শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়ন খুব জরুরি। কারন, তারা ভালো থাকলেই পরিবার ভালো থাকবে, আর পরিবার ভালো থাকলেই ভালো থাকবে দেশ'। তাই তিনি এগিয়ে এসেছেন শিক্ষার্থীদের মানসিক সেবায়। করোনা বিস্তার রোধ, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে, বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে মহৎ হৃদয়ে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রাখছেন নিয়মিত যোগাযোগ। ফলে তিনি অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের মনের কোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন।

ভালোবাসা, সহনশীলতা, বিপদে পাশে থেকে যে মানুষের মন জয় করা যায় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন  ঢাবির শিক্ষক মনিরা পারভীন। মাদার তেরেসা বলেছিলেন- "We do not need guns and bombs to bring peace, we need love and compassion".

তিনি শুধু করোনার সময়েই নয়, শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ তৈরীতে কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন - "আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন"। মনিরা পারভীন ম্যাম ও শিক্ষার্থীদের বিবেকবোধ জাগ্রত করে প্রকৃত অর্থে মানুষ তৈরিতে কাজ করছেন। তিনি দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার শিক্ষার্থীদের মাঝে যাতে তাঁরা বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে কাজ করতে পারে।

করোনা দুর্যোগ ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে দেশ ও বিদেশের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করছেন শিক্ষক মনিরা পারভীন, অংশ নিচ্ছেন দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন কনফারেন্স ও লাইভ অনুষ্ঠানে। যার মাধ্যমে তিনি করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় বার বার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিচ্ছেন এবং সেই সাথে নানাবিধ সৃজনশীল সৃষ্টিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে বলছেন।

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমার প্রিয় মানুষ কে? আমি নির্দ্বিধায় বলবো শিক্ষকেরা। শিক্ষক সমাজ শুধু আমারই প্রিয় না, আমার মত আনেকে আছেন যারা শিক্ষকদের আদর্শকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ শিক্ষক মনিরা পারভীনের মতো হজারো শিক্ষক এগিয়ে আসবে তাদের সন্তানতূল্য শিক্ষার্থীদের বিপদে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের। যার মাধ্যমে শিক্ষক সমাজের ভূমিকার কথা স্বরণ রাখবে জাতি আজীবন।

লেখক: শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/এসকেএস