রিজেন্ট হাসপাতালের নোংরা আইসিইউতে ঢুকে খোকন ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ১১:১০ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২০, ১৮:৪৬

আমানুর রহমান রনি

৭ জুলাই দুপুরে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে যাই। উদ্দেশ্য এই হাসপাতালটি মানুষের কতটা ক্ষতি করেছে তা অনুসন্ধান করা। হাসপাতালের সামনে বাইকটা রেখে সড়কে একটু দাড়ালাম।  ছয়তলা রিজেন্ট হাসপাতালের উপর থেকে নিচে তাকালাম। সময় টেলিভিশনের এক রিপোর্টারকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন বুম নিয়ে।  পাঁচগজ দূর থেকে তাকে "হায়" দিলাম, দেখলাম কোন তার অনুভূতি নাই। ভাবলাম শোনেনি। এরপর আবার 'হায় ব্রো" বলে চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করলাম। তিনি তাও পাত্তা দিলেন না। এরপর একটু নিজে নিজে শরম পেলাম। চুপ হয়ে গেলাম। তার মুখজোড়া সার্জিক্যাল মাস্ক পরা তাই চিনতে পারিনি। হয়তো তিনিও আমাকে চেনেননি। হয়তো কোন আগন্তক ভেবেছেন। তাই কথা বলার আগ্রহ পাননি।

যাইহোক সহকর্মীর কাছ থেকে প্রত্যাখিত হয়ে এবার অনুসন্ধানে মন দেয়ার পালা। রিজেন্ট গ্রুপের রিজেন্ট হাসপাতালটি কোভিড ডেডিকেটেড। তাই হাসপাতালের সামনে গিয়ে মুখটুক ভালো করে ফের চেক করে কাজ শুরু করলাম। হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে কাউকে চোখে পড়লো না। ঢুকতেই বামপাশে রিজেন্ট ফার্মেসি খোলা। দুই তরুণ ফার্মেসিতে। একজন মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে। আর এক তরুণ বসে আছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বসা তরুণের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম। তবে গল্পের ভেতরে তরুণ খুব সতর্ক। কোন তথ্য সে বলছে না। বলল সকল রোগী চলে গেছে। তারাই এখন আছে। ফার্মেসির নাম রিজেন্ট হলেও এর মালিক অন্য এক ব্যক্তি।

ফার্মেসির দুই তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এক নিরাপত্তাকর্মী হাসপাতালের গেটে ডিউটি করছে। কিন্তু আমি তাকে কোথাও দেখছি না।  তখন ফার্মেসির এক তরুণ সোহান ভাই বলে ডাক দিলো। বুঝলাম নিরাপত্তাকর্মীর নাম সোহান। তবে সে গেইটে নেই। তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পন দেখলাম লম্বা ও পাতলা এক তরুণ লম্বা পা দিয়ে হাসপাতালের গেইটে ঢুকছে।  তার পরনে নিরাপত্তা কোম্পানির পোশাক।  আমার পরিচয় দিয়ে যখন নাম জিজ্ঞাস করলাম তিনি তার পুরো নাম বললেন। হাসপাতালের বর্তমান একটা ধারণা পেলাম। উপরে যেতে চাইলাম, তবে সাহস হচ্ছিল না, কারণ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল। মনে হচ্ছে চারদিক থেকে করোনা চেপে ধরছে। তাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারলাম না। কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ফিরে এসেছি।  নিচতলার বিভিন্ন কক্ষ দেখার চেষ্টা করলাম। হাসপাতালটির অভ্যর্থনা টেবিলে ছড়ানো খবরের কাগজ আর বিভিন্ন খাতাপত্র। দোতলায় ওঠা সিঁড়ির সামনে রয়েছে সারি বাধা অক্সিজেন সিলিন্ডার।  তবে অন্যসব হাসপাতালে যেমন ট্রলিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিচতলায় থাকে সেরকম কিছু চোখে পরলো না।

নিচতলার সবকিছু খুটেখুটে দেখা শেষ এবার বাহিরে আসলাম। বাহিরে এসে ফের ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সবাই রিজেন্টের ওপর খেপে আছে! অসংখ্য অভিযোগ তাদের।

কিছুক্ষণ পর লম্বা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা দুই কিশোর ব্যাগ হাতে নিয়ে হাসপাতালের গেইট থেকে বের হচ্ছে। তাদের দেখে দৌড়ে গেলাম। গেইটেই তাদের সঙ্গে কথা বললাম। দুই কিশোর জানালো তাদের বাড়ি ময়মনসিংহ। গত সপ্তাহে তাদের এই হাসপাতালে আনা হয়েছে, তারা করোনা হাসপাতালের ভেতরেই ছিলন। তাদের আনার কারণ কোরআন তেলওয়াত করা। জিজ্ঞাস করলাম, পরিবার কি জানে, করোনা হাসপাতালে থাকা খাওয়া সব। তারা দুজনেই হেসে উত্তর দিলো, জানে। আমি আবারো জিজ্ঞাস করলাম, পরিবার এখানে আসতে দিতে রাজি হলো? তারা উত্তর দিলো, হয়েছেতো। দুই কিশোরের কথা শুনে একটু অবাক হলাম। তবে তাদের মনখারাপ তারা যে পারিশ্রমিকের জন্য এসেছিলেন, তা না নিয়েই যেতে হলো।  করোনা নিয়ে তাদের কোন ভয়ডর নেই।

বেলা তখন ২ টা প্রায়।  রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে এবার গন্তব্য রিজেন্ট গ্রুপের হেড অফিস। যেটি উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ২/এ সড়কে। এই সড়কের ১৪ নম্বর বাড়িটির দুটি ফ্লর ভাড়া নিয়ে অফিস বানিয়েছে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ।  এখানেই র্্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম দ্বিতীয় দিনের অভিযান পরিচালনার জন্য আসবেন।  তার জন্য অপেক্ষা। তিনি আসার আগে অফিসের আশপাশ কথা বললাম। এখানেও মানুষের অভিযোগের শেষ নেই।  রিজেন্ট যে অফিস নিয়েছে, তার ভাড়া দেয় না অনেক দিন!

অভিযোগ শোনা শেষ না হতেই সেখানে আসলের সারওয়ার আলম। এবার তার সঙ্গেই রিজেন্টের অফিসে ছুটছি। ভেতরে গিয়ে যা দেখলাম তা অবাক করার মতন বিষয়। করোনা সন্দেহ রোগীদের স্যাম্পল এনে তা পরীক্ষা না করে রিজেন্টের হেড অফিসে এনে ফেলে রাখা হয়েছে। অননুমোদিত কিট, অসংখ্য জাল রিপোর্ট।

নিজের চোঁখে এসব দেখে অল্পতেই বিশ্বাস করা শুরু করলাম, কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে রিজেন্ট মালিক সাহেদ যে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন, তার আড়ালে ছিল তার লোভ ও অর্থ আত্মসাতের প্রতারণার ছক।

সেখানে কাজ শেষ করে র‌্যাব গেল ফের ১১ নম্বর সেক্টরে রিজেন্ট হাসপাতালে, উদ্দেশ্য হাসপাতালটি সিলগালা করা।  হাসপাতালের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখাগেল- আইসিইউ ও ল্যাবরেটরি।  প্রথমেই র্যাব ঢুকলো আইসিইউতে। ঢুকেই সবার চোখ কপালে। কারণ আইসিইউর যে পরিবেশ তার চেয়ে গোয়াল ঘর ভালো।  বেডের নিচে কাঁথা বালিশ, কাপড় চোপড়, বোতল, থালা বাটি ইত্যাদি।  একটি টেবিলের উপর ছড়ানো ছিটানো কাগজপত্র। গায়ে গায়ে ছোটছোট বেড, পর্দার কাপড় উড়ছে। এই পরিবেশে মূমুর্ষ রোগীদের রাখা হতো! ভাবলাম। মূহুর্তেই সময়ের আলো পত্রিকার সিনিয়র সহকর্মী হুমায়ুন কবির খোকনের কথা মনে পড়লো। তাকে এই আইসিইউতে রাখা হয়েছিল, এখানেই তার মৃত্যু হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

সরকারের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যে চুক্তি, তাতে রোগীর চিকিৎসার খরচ সরকারের বহন করার কথা। কিন্তু রিজেন্ট রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসা বাবদ মোটা অংকের টাকা নিতো।  আবার মানুষকে ইচ্ছামত করোনা নেগেটিভ ও পজিটিভ রিপোর্ট দিতো।  এতে ছড়িয়েছে করোনা। মানুষের এই ক্ষতি কি এই প্রতারক চক্রকে তিনবার ফাঁসি দিলেও কাটিয়ে উঠতে পারবে কেউ? পারবে না।  কারণ সাংবাদিক হুমায়ুন কবিরের সন্তানরা আর কোনদিন তার বাবাকে ফিরে পাবেন না।

লেখক : সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন