গণমানুষের পছন্দ-অপছন্দ

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০২০, ১২:০২

কখনও কখনও আমরা মন খারাপ করে ফেলি কারণ পাড়া-প্রতিবেশী আমাদেরকে ঠিক পছন্দ করে না, দেখেই অমনি মুখ গোমড়া করে ফেলে বা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। কেন এমন করে ভেবে দেখেছেন কখনও! আমি কিন্তু ভেবেছি, রীতিমতো গবেষণাও করেছি বলতে পারেন। প্রথমেই আমার চাণক্য পণ্ডিতের কথা মনে হল। তিনি তার বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বার্থপর ও ঈর্ষাকাতর। পারতপক্ষে সে কারো ভালো দেখতে চায় না। পারেও না।

কিন্তু গণমানুষ কারা! কাদেরকে আপনি এই কাতারে রাখবেন। মূলত দুই শ্রেণির মানুষ আপনাকে মন-প্রাণভরে ঈর্ষা করে। প্রথমত, যারা আপনার নিকটাত্মীয় এবং আপনাকে প্রতিযোগী বলে মনে করে। আর দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে সেই গণমানুষ, যারা কিনা চাণক্যবাবুর কথামতো জন্মগতভাবেই নিন্দুক, হীনবল, পরশ্রীকাতর এবং সংকীর্ণ চিত্তের অধিকারী। আমি অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমার তুলনায় খুব নিচুতে ও উঁচুতে অবস্থানকারীরা আমাকে নিয়ে ভাবে না, বা ভাবলেও ক্ষতির চিন্তা করে না খুব একটা। কিন্তু যারা আমার প্রায় সমকক্ষ কিন্তু পদে-পদবীতে ধারেকাছে নেই, বা যোগ্যতা দক্ষতায় এঁটে উঠতে পারছে না তারাই আমার ‘র্সোন এনিমি’ অর্থাৎ পরম শত্রু। কার্যে পরিণত করতে পারুক বা না-পারুক, তারা আমার ক্ষতি করতে চায়। কায়োমনবাক্যে আমার ক্ষতির চিন্তা করে। প্রায়শ আমি তাদেরকে খুব একটা পাত্তা দিই না। দিলেই ক্ষতি, না দিলে সমস্যার কিছু নেই। তাদের কথা ভাবলেই আমার রুচি নিম্নগামী হবে জানি, আমার ঘুমেও প্রবলেম হবে।

আপনি দেখতে ভাল, আপনার যথেষ্ট হাইট, চেহারায় সম্ভ্রান্তি আছে, আপনাকে দেখে লোকে সমীহের চোখে তাকায়। ব্যস, এটুকুই আপনাকে ওইসকল নিন্দুকের কাছে অসোয়াস্তির কারণ করে তুলবে। ঘরে আপনার সুশ্রী, বিদুষী এবং বিশ^স্ত স্ত্রীধন রয়েছে। এরপরও কি আপনি আশা করতে পারবেন যে আপনার মোটে শত্রু থাকবে না! কেননা, আমাদের মাঝে এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা কিনা চরম পরস্ত্রীকাতর। আপনার বউভাগ্য আর সৌভাগ্য নিদর্শন দেখে তারা সমানে জ¦লে, মনে মনে আপনার কিছু ক্ষতির চিন্তাও করে থাকবে। তারপর আপনার যদি দুচারটে সুন্দর দেখতে ও মেধাবী ছেলেমেয়ে থাকে তবেই কাজ সেরেছে। ওরা আর আপনাকে চর্মচক্ষে দেখতে চাইবে না। মনে মনে ভাববে আর ঈর্ষার আগুনে জ¦লবে। এটাই তাদের নিয়তি।

তারপর ধরুন সমাজে আপনার একটা বিশেষ অবস্থান আছে, লোকে আপনাকে মানে গোনে, সালামাদি দেয়, আপনি একজন সফল ব্যবসায়ী বা উঁচুপদে চাকরি করেন। আবার মেলা ক্ষমতাও আছে। এতসব গুণপনা জেনেও কি সেই সর্বহারার দল আপনাকে বন্ধু ভাবতে পারবে! পারবে না। বুকের ভেতর তাদের জ¦লুনি বাড়বে, আর শয়নে-স্বপনে-নিশিজাগরণে তারা আপনাকে সমানে শাপ-শাপান্ত করবে। আপনার কোনো একটা ক্ষতির খবর শোনার জন্য গ্রে হাউন্ডের মতো উৎকর্ণ হয়ে থাকবে।

আপনি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, আপনি সঠিক শব্দ চয়ন করে সুন্দর গুছিয়ে কথাও বলেন, আন্জাম লোকেরা দাঁড়িয়ে আপনার কথা শোনে। আপনাকে গণমাধ্যমে বা টিভির পর্দায় মাঝেসাঝে দেখাও যায়। সেই অর্থে আপনাকে ছোটোখাটো সেলেব্রিটিও বলা যায়। ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে আপনি মোটামুটি সফল। ব্যস, হয়ে গেল! আপনি যত বেশি উচ্চকিত হবেন, ততই আপনার শত্রুসংখ্যা বাড়বে। লোকে আপনাকে অপছন্দ করতে শুরু করবে। এটাই দস্তুর। এমনই হয়। আপনার ঈর্ষণীয় সাফল্য ক্রমশ আপনাকে একা করে ফেলবে। দোষ আপনার নয়, ওদের- ওইসকল হীনমন্য ও বন্য লোকেদের।

এ তো গেল বাহ্যিক বিষয়াদি। আপনার আরও একখানা গুণ রয়েছে। আপনি টুকটাক লেখেন। টুকটাক না, বেশ ভালই লেখেন আপনি। আপনার লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়, দেশে-বিদেশে পাঠকও রয়েছে প্রচুর। তারা আপনার সাহিত্যসম্ভারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নিজখরচে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আপনার জন্য শংসাবচন পাঠ করে। নিন্দুকেরা সেসব শোনে কিন্তু মানতে চায় না। তাদের মতে পাতিলেখক আপনি, লেখা তো নয়, স্রেফ কলমপেষা। কিন্তু ওরা যাই বলুক, আদতে লেখক হিসেবে আপনার অবস্থান সুদৃঢ়। আপনি প্রচুর পড়েন এবং জানেন, জেনেশুনে লেখেন বিধায় আপনার লেখায় সারবত্তা রয়েছে। আপনি ফেসবুককেন্দ্রিক ‘মুরিদাশ্রয়ী’ লেখক নন। আপনার লেখায় জীবন আছে। ফলে বোদ্ধাপাঠক আপনাকে না পড়ে যাবে কোথায়!

ফলে হল কি, আপনি নিজের হাতে শত্রু পয়দা করলেন। স্বার্থপর হিংসুটে মানুষ আপনার এত এত গুণ তো আর নিতে পারবে না। ওরা সুযোগ পেলেই আপনার নিন্দেমন্দ করবে, আপনার থেকে সুবিধা নেবে, অথচ ঋণ স্বীকার দূরের কথা, ওরা আপনার ক্ষতি করতেও পিছপা হবে না। ওরা ‘বাই নেচার’ কৃতঘ্ন তো তাই।

গণমানুষ আপনার আরো একটা বিষয় মানতে নারাজ। আপনি খানিক হাতখোলা স্বভাবের। মিষ্টি হেসে কথা বলেন। মানুষকে টুকটাক হেল্প করেন। আর্থিক ও মানসিক উভয় প্রকারে। ফলে কিছু লোক জনসমক্ষে আপনার প্রশংসা করে। নিন্দুক যারা তারা এটা সহ্য করবে না। ওরা চায় আপনার প্রচুর বদনাম হোক, আপনি জনারণ্যে অপদস্থ হোন, তাতেই তাদের শান্তি।

আপনি যদি হন পুরুষ তাহলে আপনার বেশকিছু নারীবন্ধুও জুটবে। কারণ আপনি গুণবান বটে। নানান বয়সের, নানা ক্লাসের বন্ধু। তারা সব দেখতে সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা এবং স্পেক্ট্যাকুলার, মানে চোখে পড়বার মতো। এসব মেয়েবন্ধু আপনাকে দিল খুলে ভালোবাসে, ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হাত খুলে ছয়ের মারের মতোন যত্রতত্র ওরা আপনার উত্তুঙ্গ প্রশংসা করে। এরপরও যদি আপনি মনে করেন যে নিকটাত্মীয়রা আপনার নিন্দেমন্দ করবে না, তাহলে আমি বলতে বাধ্য যে মানবচরিত্র সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আপনি সদ্যোজাত শিশুর মতোই নাদান এবং নির্বোধ। চুষিকাঠি মুখে নিয়ে হাত-পা ছুড়ে শুধু টালুক টালুক তাকাতে জানেন, কিন্তু মানুষ চেনেন না।

একটু খেয়াল করে দেখুন, কার শত্রু নেই! যে কিনা বোবা, কালা, বধিরÑ পাতে দেবার অযোগ্য। যার জীবনে কোনো অর্জন নেই, যে শুধু খায় আর বর্জন করে, উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়ায়। মড়াকে খুব কম লোকেই মারতে চায়। উল্টো করে বললে, গাছে ফল ফললে লোকে তা ঢিলাবেই। লোকে গলা খুলে আপনার সমালোচনা করছে, তার মানে আপনি উপরে উঠছেন। অফিসের নিরীহ গোবেচারা লোকটাকে কেউ খুব একটা পোঁছে না। তাকে সবাই করুণার চোখে দেখে। কাজের দরকার নেই, বসে বসে বসকে তেল মারুন, দেখবেন কেউ আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। যেই না আপনি কাজ করছেন বা নিজের যোগ্যতা দেখাচ্ছেন, অমনি দেখবেন অফিসসুদ্ধ লোক আপনাকে ল্যাং মারতে উঠে পড়ে লেগেছে।

আমপাবলিক বড্ড সমাজতান্ত্রিক। তারা আশেপাশের সবাইকে এক কাতারে দেখতে চায়। আপনি উপরে উঠেছেন কি, কাঁকড়ার মতো সবাই আপনাকে টেনে নামাতে মরিয়া হয়ে উঠবে। ভাল কিছু করলে আপনি গালাগাল খাবেনই। বিলাইয়ের মতো মিউ মিউ করুন, দেখবেন আপনার বন্ধুর অভাব নেই। নিরীহ গাধারা একপালে থাকে, কিন্তু সিংহ বা ব্যাঘ্র নয়। তারা একাকী শিকার ধরতেই বেশি পছন্দ করে।

তাই বলি কি, আপনি গাধা নাকি সিংহ হবেন সেটা আপনিই ঠিক করুন। জ্ঞানী মানুষ বরাবরই নিঃসঙ্গ হয়। যুদ্ধে সেনাপতি একজনই থাকে, সৈনিক অনেক। যাদের মুরিদ বেশি কিন্তু মুরোদ কম, তারা মানুষ ভালো এমন ভাবার বস্তুত কোনো কারণ নেই। ওই যে, বানর কিংবা গাধাÑ ওরা দলেবলে চলে। একা চলার তাদের সাহস কোথায়! ওরা ‘মিডিওকার’ তাই নতুন কিছু আবিষ্কার করবার মুরোদ কিংবা সাহস নেই। ওরা গতানুগতিকতায় বিশ^াসী। একে অপরের সঙ্গে ওরা তেলাতেলির সম্পর্ক বজায় রাখে।

আর যারা সবাইকে খুশি রাখতে চায় তারা ব্যক্তিত্বহীন। বাস্তবে সেটা কখনও সম্ভবও নেই। মেনি মেন মেনি মাইন্ডস। একা আপনি সবার মনের খবর রাখবেন কী করে! রাখতে গেলে নিজেই দেখবেন একদিন ফিনিশ হয়ে গেছেন, কিংবা সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মতো গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আপনার আর মৌলিকত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তাই প্রিয়ভাজন নয়, বরং স্বাধীনচেতা হন। নিজের আত্মার কাছে পরিষ্কার থাকুন। দেখবেন জীবনটা অর্থবহ হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :