গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে বাজারব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের এখনই সুযোগ

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ১২:৪৯ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২০, ১৩:৩৭

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর একটি উপজেলা। এখানে অন্যান্য এলাকার মতো প্রতিদিন বাজারে হাজার হাজার লোক সমাগাম হতো। হাটের দিনে সে লোকের সমাগম ছিল আরো বিস্ময়জনক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা ছাড়াও অনেকে আড্ডা দেবার জন্য চায়ের দোকান বা অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে জমায়েত হতো। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলা নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এবং প্রশাসন থেকে এই বিষয়ে চাপ থাকায় লোকজন বাজারে তাদের উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে।

করোনার এই সময়ে বাজারসহ চিরায়াত জীবন ও জীবিকা পদ্ধতিতে এসেছে জীবনমুখী নানা বিশেষ পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কুষ্টিয়ার মিরপুরে শুধু নয় বাংলাদেশের আরো অনেক জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়নেও সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।

একটা কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি- মাছে ভাতে বাঙালি। হয়তো আগের মত গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা বা নদী ভরা মাছ আমাদের নেই, হয়তো নেই ইলিশের প্রতুলতা, কিন্তু তাই বলে বাঙালির রুচি-অভ্যাসে যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তাও নয়। বাজারে গরুর মাংসের দাম বেশি হওয়ায় ও রুচির কারণেই এখনো মাছের প্রতি বিশেষ টান।

বরতমান পারিপার্শ্বিকতার কারণে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে মাছের অস্থায়ী দোকান লক্ষ করা যায়। তবে সেসব মাছ খাল, বিল বা নদীর মাছ নয়, পুকুরে চাষ করা। এসব দোকান থেকে লোকজন আনন্দের সাথে মাছকেনে। স্থানীয় মাছ বিক্রেতা এলাকার মাছের চাহিদা সমন্ধে ভালো ধারণা আছে বলে দ্রুত তার ব্যবসার প্রসার করতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্রামের বাজার বা শহরের বাজার এরকম কোনো ভেদাভেদ থাকে না।

দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ ও তাদের অর্থনীতি উন্নতির দিকে প্রবাহিত হওয়ায় ভাবনার সময় এসেছে যে শুধু শহরে নয়, গ্রামও হতে পারে বাজার ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। আর তা কীভাবে হবে তা দেখিয়ে দিতেই মূলত এই লেখা।

পবিত্র রমজান মাসের বাহারি ইফতারির জন্য একসময় বাজারে বাজারে দোকানে তৈরি করা হতো নানা রকম ইফতারের আইটেম। কিন্তু করোনাকালে এবার এই কেন্দ্রীকরণের পরিবর্তন দেখা গেছে। গ্রামের ‍গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করেছে কিছু লোকজন। গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের বাজারে যাবার চেয়ে এসব মোড়ে মোড়ে বসা অস্থায়ী দোকান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ইফতারের আইটেম সংগ্রহ করেছে।

পরিবহন সমস্যার কারণে পণ্য আনা-নেওয়া করার সমস্যা থাকায় স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যও স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হয় স্থানীয় বাজারে। অনেক কৃষিপণ্য উৎপাদক খুচরা বিক্রি করে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করে আবার অনেক পণ্যে উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে গেছে যা কৃষকদের ক্ষতির কারণ। স্থানীয় বাজারে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রাপ্তি অপ্রয়োজনে বাইরে যাবার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। নিয়মিত বাজারের বিকল্প হবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় বাজার।

স্থানীয় স্টেশনারি বা মনোহারি দোকানেও আগের চেয়ে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করার মাত্রায় পার্থক্য দেখা যায়। অনেক দোকান তাদের গতানুগতিক পণ্যের বাইরে এমন কিছু পণ্য রাখছে যা কিনতে একসময় বাজারে না গেলে হতো না। অনেক ক্রেতা বাজারে যাবার ঝামেলা এড়াতে দোকানের এই সুযোগগুলো সীমিত পরিসরে হলেও গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। সময় বাঁচিয়ে অন্য কাজে তা ব্যয় করতে পারছে পর্যাপ্ত। এই প্রবণতা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

স্থানীয় বাজার ব্যবস্থায় অনেক পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার অসন্তোষ লক্ষ্ করা গেলেও তার সুবিধা কম নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা খাদ্যে ভেজাল মানুষের বিশেষ অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আছে দীর্ঘদিন। কৃষকরাও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য বা বাজারজাতকরণ সমস্যা নিয়ে ভুগছিলো। স্থানীয় চাহিদা বা দেশীয় চাহিদার মাপকাঠি নির্ধারণ করা বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। করোনার এই জটিল পরিস্থিতিতে মানুষ তার চাহিদাকে সীমিত করার চেষ্টার মাধ্যমে যতটুকু পারছে তাদের রুচি, অভ্যাস আর আচরণে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। এই পরিবর্তগুলো ইতিবাচক ও স্থায়ী কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে কি না বা ইতিবাচক করা যায় কি না তা অবশ্যই চিন্তায় রাখা যায।

বিনিময় প্রথায় অত্যাবশকীয় বস্তুগুলো প্রাধান্য পেত। প্রয়োজনই জীবনকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। কিছুদিন আগেও গ্রামীণ মানুষের চাহিদা ছিলো সীমিত। এখন মোবাইল সেট, টিভি, ফ্রিজ, মটরসাইকেল বা অন্যান্য বিলাসদ্রব্যও কোনো না কোনোভাবে মানুষ তার প্রয়োজনের তালিকায় বুঝে না বুঝে যুক্ত করে ফেলেছিলো যা সামাজিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলায বিশেষ প্রভাব রেখে চলছিলো। বিলাসদ্রব্যগুলো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় ‍যুক্ত করায় বাজার ব্যবস্থায় বিশেষ মাত্রা এসছিল। এই গন্ডিতে বিশেষ পরিবর্তন আমরা পাই। চাহিদা ও বাজারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ শুধু মানুষকে উচ্চাভিলাষী থেকেই নয় অর্থনীতির নতুন গতিপথ নির্ধারণেও নতুন ধারণা দেয়।

বাজেট নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা চলছে এবং এটা আগামী বাজেট না আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিন্তু আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামের বাজার ব্যবস্থা নিয়ে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করছি না। যদি বাজারব্যবস্থা স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছর পেরিয়ে এই সময়ে বিকেন্দ্রীকরণ থাকত, তাহলে করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সুবিধা হতো। একটা বাজারে যত লোকসমাগম হয় তা যদি ভিন্ন ভিন্ন বাজারে যেত তাহলে তা অধিক জনসংখ্যার এই দেশে সংক্রামক রোগ থেকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করত। করোনাকালের এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাস থেকেও রক্ষা করা যাবে দেশবাসীকে, যেটি এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ এখন তাদের প্রয়োজনকেই প্রয়োজনীয় করে তুলে জীবন সাজানোর চেষ্টা করছে। কৃষি ও কৃষিপণ্যের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। শ্রম ও শ্রমিকের যে গুরুত্ব তা হচ্ছে স্পষ্ট। বিলাসিতা ও বিবেক স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। জীবনের চাহিদা কমিয়েও যে নিজেদের সুখী করা যায় এ বোধ তাদের ভিতর জন্ম নিচ্ছে ধীরে ধীরে। ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে কিছু নেতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই আছে। সেটা এই আলোচনাকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে । তবে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রয়োজনীয়তার যে শিক্ষা গ্রামীণ অর্থনীতিতে উঁকি দিচ্ছে তার ফল ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে কোনোটিই হতে পারে, যা নির্ভর করে পদক্ষেপ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সামগ্রিক সুচিন্তার ওপর ।

বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে যা করণীয় বা আমরা যেসব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি এবং বর্তমানে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর শিক্ষা আমরা কাজে লাগাতে পারি ও কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা নিতে পারি, সে বিষয়ে কিছু মত নিচে তুলে ধরছি।

(১) গ্রামীণ অর্থনীতিই খাদ্যমন্দা ও দূর্ভিক্ষ দূর করতে পারে।

(২) আমদানি নয় নিজস্ব পণ্য বাজারজাত ও সংরক্ষণের সহজ সমাধানে বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করা।

(৩)বিলাসদ্রব্য বা পণ্য মানুষের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বাধা, প্রয়োজনই মানুষের জীবনকে প্রয়োজনীয় করে তোলে।

(৪)শিক্ষা খাতে তথা নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ছাড়া সেবার মান (সার্ভিস ডেলিভারি) উন্নত করা সম্ভব না।

(৫)ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নয় বরং নিজের শ্রম ও তার বাস্তব উপযোগিতাই (উদ্যোক্তা হওয়া নিজে) সব পরিবর্তন করতে পারে।

(৬)উৎপাদন, উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদক, শ্রম ও শ্রমিকের বিকেন্দ্রীকরণ অর্থনীতির মোড় ঘোরাতে যথেষ্ট।

(৭) বাজার চাহিদা তৈরি করে নয়, প্রয়োজন ও প্রাপ্তি দিয়েও তৈরি করা যায়।

(৮) রাষ্ট্রের ব্যয়ভার কমানো ও নাগরিক সুবিধা উন্নতির সাথে বাজার ব্যবস্থার গুরুত্ব আছে।

(৯)করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাজার ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।

আমরা কখনোই হতাশাগ্রস্ত বা নিরাশাবাদী নই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেপ্রেমিক জনগণ কখনো হতাশাগ্রস্ত হতে পারে না। তাই এই করোনাভাইরাস থেকে উত্তরণ ও কিছুটা হলেও রেহাই পেতে বাজার ব্যবস্থাসহ গ্রামীণ অন্যান্য অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। তাতে অর্থনীতিও বাঁচবে আমরা জনগণও বাঁচব।

চিন্তার শুরু ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাস্তব এমন কিছু অবস্থান তৈরি করে, যা হয়তো অলৌকিক মনে হয়। লৌকিককে অলৌকিক করাও একনিষ্ঠ কর্ম ও পরিশ্রমের ফল এবং ফসল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও তার শিক্ষা পরবর্তী বড় সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারবে। তাই নীতিনির্ধারকরা এখনই কাজ শুরু করতে পারেন।

লেখকঃ কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক। ই-মেইলঃ [email protected]

(ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/মোআ)