আপনার বেতনটা ঈদের পরে দেব…

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০২০, ১৩:১০

টুটুল জহিরুল ইসলাম

টিউশনির গল্প-১, সময়কাল ২০০১ সাল। যেহেতু স্টুডেন্ট অবস্থায়ই বিয়ে করে ফেলেছিলাম, সেহেতু টিউশনিটাই ছিল আয়ের একমাত্র উৎস। টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পেতাম, ততটুকু সময় গান, কবিতা আর নিজের বিনোদন চর্চ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতাম। বউকে সময় দিতাম।

চলুন আসল গল্পে যাই। ওটা ছিল আমার পুরান ঢাকার একেবারে প্রথম টিউশনি। আর টিউশনি ক্যারিয়ারের তৃতীয়। দুজন ছিল টুইন বাচ্চা। দুজনই ক্লাস থ্রিতে পড়তো। পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশেই তাদের বিরাট বাড়ি। বাবা বেশ বড় ব্যবসায়ী।

কুরবানী ঈদের দেড়মাস আগে ওখানে টিউশনি শুরু করলাম। সপ্তাহে ৫ দিন যাই। বেতন নির্ধারণ হলো চার হাজার টাকা। আমি তখন ভীষণ অভাবী মানুষ। মাকে আর বউকে নিয়ে একাই যুদ্ধ করে যাচ্ছি। খুব কঠিন সময়। সে সময় চার হাজার টাকা মানে আমার কাছে চার লাখ টাকা! খুব মনযোগ দিয়ে পড়ানো শুরু করলাম। একদিনও মিস করিনা। নিজের ক্লাসে ঠিকমতো যাই না, কিন্তু টিউশনিতে একদম ঠিকঠাক! মাত্র তিনটা টিউশনি করি তখন। দু'টোতে আড়াই হাজার করে পাঁচ হাজার আর এই নতুনটাতে মাস শেষ হলে পাবো চার হাজার।

আমি প্রতিদিন যাই, পড়াই, আর ক্যালেন্ডারের দিকে নজর দেই, কবে মাস শেষ হবে? মাস শেষ হলে চার হাজার টাকা! সামনে আবার ঈদ। দুপুরে কোন রকম চারটা ডালভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম, ফিরতাম সন্ধ্যার অনেক পর। মনে মনে আরো টিউশনিও খুঁজতাম।

অবশেষে সেই চার হাজার টাকার টিউশনির মাস শেষ হয়ে এলো। অন্য দুটো টিউশনির টাকা অলরেডি পেয়ে গেছি। সামনেই কুরবানি ঈদ। কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য নেই, কিন্তু মা আর বউকে তো দুটো নতুন শাড়ি কিনে দেয়াই যায়। কিনে দিলাম। বাকী কিছু টাকা দিয়ে সামান্য বাজার করে রাখলাম ঈদের জন্য। টাকা প্রায় শেষ। এখন শুধু আশায় আছি সেই চার হাজার টাকার জন্য।

মাস শেষ হয়ে গেলো। বেতনের খবর নাই। প্রতিদিন যাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বলেনা কেউ। ঈদের বাকী আর সাতদিন। সাধারণত এসময় স্টুডেন্ট ছুটি নিয়ে নেয় বা দিতে হয়। আমি তবুও যাচ্ছি, বেতনটা যে আমার লাগবেই! চার হাজার টাকা! এটা ছাড়া চলবো কি করে? টাকাও তো শেষ!

ঈদের ঠিক তিনদিন আগে দরজা ঠেলে স্টুডেন্টের মা সামনে এলেন। আমি ভাবলাম, যাক ছুটিও পাচ্ছি, টাকাও পাবো আজ! হাসিমুখে সালাম দিলাম। উনিও হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন।

এরপর বলতে লাগলেন, 'স্যার আপনে আবার ঈদের পর থেইকা ওদের পড়াইয়েন, আমরাই কল দিবোনে।’ এইটুকু বলে উনি কিছুটা থামলেন। আমি ভাবতে লাগলাম, এই বুঝি বেতনটা তুলে দিবেন। উত্তেজনা বাড়ছে আমার। উনি আবার শুরু করলেন, 'স্যার ওদের বাবার ব্যবসার অবস্থা ভালো না, প্রতিবছর তিনটা গরু কুরবানি দেই, এইবার দেড়লাখ টাকা দিয়া মাত্র দুইটা কিনতে পারছে, তাই স্যার কিছু মনে কইরেন না, আপনের বেতনটা ঈদের পরেই দিবোনে।’

টেবিলের উপরে দুটো মিষ্টি রাখা। খেতে বলে উনি বিদায় নিলেন। আমি স্তব্ধ! উনাদের দেড় লাখ টাকার গরু কেনা সত্ত্বেও আফসোস, অথচ আমি মাত্র চার হাজার টাকার জন্য এতো আফসোস করবো! একজন টিউশনির করে বেড়ানো শিক্ষকের আবার কিসের ঈদ?

চোখ ভিজে আসছিল, বুঝতে পারছিলাম এখনি গাল বেয়ে পড়বে হয়তো। কোনরকম সামলে নিয়ে সেই বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। গ্যারেজের সামনে দুটো কালচে লাল রঙের গরু বাঁধা। সেই দেড় লাখ টাকার গরু!

ঈদের পর আর সেই টিউশনিতে যাইনি। উনারাও আর ফোন করেননি! সত্যি বলছি ফোন করেননি!! বাচ্চা দুটোর জন্য মায়া হতো মাঝেমধ্যেই, ওরা আমাকে ভীষণ পছন্দ করেছিল। প্রাপ্তি ওটাই.....

লেখক:  আর জে ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/এসকেএস