শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমেও করোনার থাবা

প্রকাশ | ০৯ জুলাই ২০২০, ১৫:৩২ | আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২০, ১৭:১১

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের জীবনের নানা ক্ষেত্র প্রায় থমকে গিয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছে মা ও শিশুদের টিকাদান কর্মসূচিতেও। গত এপ্রিল ও মে মাসে দেশের প্রায় আড়াই লাখ মা ও শিশুর টিকাদান ব্যাহত হয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির কারণে।

সরকারের ম্যাটারনাল এন্ড নিওন্যাটাল হেলথ কেয়ার (এমএনসিএএইচ) বলছে, টিকা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ মজুত ছিল। কিন্তু করোনার কারণে উদ্ভূত পরস্থিতিতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)।

দুই মাসের বেশি সময় সবকিছু থমকে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সচল হতে চলছে জীবনযাত্রা। জানা গেছে, জুনের শুরু থেকে ইপিআই কর্মসূচি গ্রামাঞ্চলে কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে এখনো শহর এলাকায় কার্যক্রমে খুব একটা গতি আসেনি।

টিকাদান কেন্দ্রগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু করোনার সংক্রমণের ভয়েই নয়, দীর্ঘ ছুটিতে অনেক পরিবার এলাকা ত্যাগ করায় শিশুরা নিয়মিত যে কেন্দ্রে টিকা নিত সেখানে যেতে পারেনি। আবার অনেকে টিকার কার্ডটিও হয়তো নিতে ভুলে গেছেন। তাই চাইলেও কাছের অন্য কেন্দ্রে গিয়ে টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি।

এখন ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো টিকদান কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমও স্বাভাবিক হচ্ছে। কীভাবে দুর্যোগের সময় কাজ করতে হবে, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেই দিকনির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা পেয়েছেন। আর বাদ পড়া শিশু-মায়েদের তালিকা করে টিকা দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।

 

টিকাদান ব্যাহত হওয়ায় ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

 

যেসব শিশু সময়মতো টিকা নিতে পারেনি, তাদের নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে হাম-রুবেলার মতো রোগের টিকা দিতে না-পারা শিশুদের নিয়ে আতঙ্ক কিছুটা বেশি। কারণ গত এপ্রিলের মাঝামাঝি পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু ও নবজাতককে সঠিক সময়ে তাদের টিকাগুলো দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব টিকা যেমন মৃত্যুঝুঁকি কমায়, তেমনি জটিল রোগ থেকে তাদের রক্ষা করে।

তবে দুই-তিন মাসের বিরতিকে খুব বড় সমস্যাও মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যদি তিনটি ডোজের দুটি সম্পন্ন করার পর একটা বাদ পড়ে, সেক্ষেত্রে খুব বড় সমস্যার সম্ভাবনা কম। তবে দ্রুত সেই টিকা গ্রহণ করাটা ভালো।

যেসব রোগ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য শিশুদের টিকা দেয়া হয়, সেসব রোগের ভয়াবহতা, সংক্রমণ এবং মৃত্যুঝুঁকি করোনার চেয়ে বরং বেশি।

শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ কথা মনে রেখেই আমাদের বাচ্চাদের টিকা দিতে হবে।’

এই সময়ে টিকা নিতে যাওয়ার সময় করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘মা ভালো মানের মাস্ক পরে নেবেন। আর যে বাচ্চাকে মাস্ক পরানো যাবে না, তাদের মায়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে নিলেও চলবে।’

 

আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের

 

টিকাদান ব্যাহত হলেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, টিকা না দেয়ার সময়টা দীর্ঘ হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।

সরকারি সংস্থাটির হিসাবমতে, গত এপ্রিল ও মে মাসে টিকাদান প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছে দুই থেকে আড়াই লাখ মা ও শিশু। স্বাভাবিক সময় ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ মা ও শিশুকে টিকা দেয়া সম্ভব হতো। করোনার কারণে ওই দুই মাসে তা ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

করোনার আতঙ্কে এখনো লোকজনের উপস্থিতি কম-বেশি যা-ই হোক, ইতোমধ্যে সব টিকাদান কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। যারা এপ্রিল-মে মাসে শিশুদের টিকা দেননি তারা পরেও দিতে পারবেন। কারণ টিকা নির্ধারিত দিনের আগে দেয়া যায় না।

করোনার কারণে টিকাদান কর্মসূচির ব্যাঘাত ঘটায় টিকাদান টার্গেটের ১০ শতাংশ কমেছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মা, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. শামসুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, তবে ভয়ের কিছু নেই।

শামসুল হক বলেন, ‘যদি টিকাদান কর্মসূচি ভেঙে পড়ে তাহলে নিউমোনিয়া-হামের মতো রোগগুলোর কারণে শিশুমৃত্যু বাড়বে। কিন্তু সেটা তখনই ভয়ের হতো যখন বছরের পর বছর টিকা দেয়া সম্ভব না হতো। আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এপ্রিল-মে মাসে প্রায় আড়াই লাখ শিশু নিয়মিত টিকা পায়নি, চলতি মাসে তা আবার চালু করা গেছে।’

 

যেভাবে ব্যাহত হয়েছে টিকাদান

 

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত মার্চের শেষের দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে অনেকে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যান। তাদের অনেকে টিকার কাগজটি হয়তো নেননি। লকডাউনের কারণে কেন্দ্রগুলো যেমন বন্ধ ছিল তেমনি শিশুরাও পুরোপুরি ঘরবন্দি ছিল। ফলে টিকা দিতে পারেনি অনেকেই।

গ্রাম ও শহরে দুভাবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। গ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে, আর শহরে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে। লকডাউনের কারণে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি যেতে পারেননি। অনেক পরিবার থেকেও ওই সময়ে বাধা দেয়া হয়েছে। এভাবেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে টিকাদান কার্যক্রম।

 

এখন টিকা নেওয়া যাবে?

 

ঢাকার বকশিবাজারের সূর্যের হাসি ক্লিনিকের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত কেন্দ্র খোলা রাখলেও টিকা নিতে আসেনি অনেকে। তাদের তালিকা আছে। এখন তারা চাইলেই কেন্দ্রে এসে টিকাটা নিয়ে নিতে পারবেন।’

ইপিআইয়ের প্রকল্প পরিচালক ডা. মাওলা বকশ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এপ্রিল ও মে মাসে সব মানুষ আতঙ্কে ছিল। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেকের বাড়ি গেলেও ভয়ে শিশু ও মায়েরা টিকা নেননি। তবে যারা বাদ পড়েছে তাদের অবশ্যই টিকাদান কার‌্যক্রমের মধ্যে আনতে সক্ষম হব। সেভাবেই কাজ করা হচ্ছে।’

(ঢাকাটাইমস/৯জুলাই/বিইউ/মোআ)