বঙ্গবন্ধু ও আমার সন্তানেরা

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২০, ০৯:৩৯

রাজু আলাউদ্দিন

বঙ্গবন্ধুকে আমি দুবার দেখেছি। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা তা দুদিন আগেও জানতো না। মায়া যখন নার্সারিতে পড়ে, মানে বছর দুয়েক আছে, তখনই সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটির সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। তাকে যে হত্যা করা হয়েছিল সেটা তাকে জানিয়েছিলাম। তখন সে জানতে চাইলো কারা মেরেছে। আমি বলেছিলাম খারাপ লোকরা তাকে মেরেছে। তারপর ওর প্রতিক্রিয়াটা হলো, আমি ওই খারাপ লোকগুলোকে মারবো। ব্যাস, ওইটুকুই ।

গত পরশুদিন কথায় কথায় আবার বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলো, আগেও এসেছিল নানা সূত্রে, কিন্তু পরশুদিনই প্রথম ওকে বললাম, জানো, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, একবার নয়, দুবার দেখেছি। আমার কথা শুনে তো মেয়ের চোখ ছানাবড়া। এত বড় এক কিংবদন্তী পুরুষকে আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ কেউ চাক্ষুষ করেছে-- এটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য বলে সে বিস্মিত। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার ধারণা আরও বিস্তৃত হয়েছে পাঠ্যপুস্তকের সূত্রে। সেটা আমার ছেলেরও হয়েছে। ছেলে ওর চেয়ে আরও বেশিই জানে। কিন্তু ছেলেও জানতো না যে আমি বঙ্গবন্ধুকে নিজ চোখে দেখেছি।

প্রথমে মায়াকে যখন বললাম হ্যাঁ, আমি দেখেছি, প্রথমবার দেখেছি ৭ই মার্চের ভাষণদান রত বঙ্গবন্ধুকে, আমার বয়স তখন ৯, উত্তাল জনসমুদ্রে আমি একটি খড়ের কুটোর মতো ভাসছিলাম। আমার সেখানে ওই বয়সে থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার এক চাচাতো ভাই নুরুল আমিন ছিলেন আওয়ামী লীগার, তিনি ছিলেন আমাদের গৃহ শিক্ষক, তিনিই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনাতে। কী সৌভাগ্য যে আমি সেই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী। আর দ্বিতীয়বার তাকে দেখেছি যখন আমি করাতিটোলা হাই স্কুলের ছাত্র। দেশ তখন স্বাধীন। কিন্তু সালটা আমার স্পষ্টভাবে মনে নেই, সম্ভবত ৭৪ সাল হবে।

শিক্ষকরা সকালবেলায়ই সব ছাত্রদেরকে জানিয়ে দিলেন আজকে বঙ্গবন্ধু এই পথ দিয়ে যাবেন। আমরা গভীর উৎসাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি কখন তিনি আসবেন, কখন দেখতে পাবো এই নির্ভীক বীর পুরুষকে। খুব বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। তিনি এলেন। সাদামাটা একটি কালো রংয়ের গাড়ির পেছনের সিটে তিনি বসে আছেন। তার সামনে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি আর পেছনে আরেকটি। এই ছিল তার সামগ্রিক নিরাপত্তা। কিন্তু আমাদের সবার চোখ সেটে আছে ওই রূপকথার বীর পুরুষের দিকে।

কী সুদর্শন, সহাস্য এক বিশাল ব্যক্তিত্ব হাত নাড়িয়ে আমাদের ভালোবাসার জবাব দিয়েছিলেন। গাড়ি থেকে নামেননি তিনি, আমাদের ভালোবাসাকে হৃদয়ে মেখে নেয়ার জন্য গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিলেন। ওই তাকে দ্বিতীয়বার দেখা। কিন্তু তিনি এমনই এক প্রবল ব্যক্তিত্ব যে ওই অল্পবয়সের দেখাটাও স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। যে-তাকে একবার দেখেছে সে কি ভুলতে পারে! এই দেখার কথাই বলছিলাম মেয়েকে।

এই দেখার কথা শুনে মনে হলো মেয়েটা মনে মনে গর্ববোধ করছে। গর্ববোধ করেছে তার প্রমাণ হলো এই যে স্কুল যখন খুলবে তখন নাকি ওর বন্ধুদের বলবে ওর বাবা বঙ্গবন্ধুকে দুবার দেখেছে। গর্ববোধ না হলে কি এমন চিন্তা মাথায় আসে ওই ছো্ট্ট বয়সে? কিন্তু মেয়েকে ওই সাক্ষাত দর্শনের কথা বলতে গিয়ে পড়তে হলো আরেক বিপদে। এই আশ্চর্য ঘটনার কথা সে কিছুক্ষণ পরেই তার ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে। ওর ভাই প্রায় মারমুখী হয়ে আমাকে জেরা করতে শুরু করলো: ঘটনা সত্যি কিনা। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতেই বললাম, হ্যাঁ।

এবার তার ক্রুদ্ধ হওয়ার পালা। আমি কেন তাকে এতদিন একথা বলিনি। রাগে প্রায় ফেটে পরার অবস্থা। যেন ওকে আমি বহুদিন ধরে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে বঞ্চিত করে এসেছি। আমি বললাম, জানতে চাওনি তাই বলিনি। প্রসঙ্গ আসেনি তাই বলা হয়নি। কিন্তু ওর অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো, আমার না বলাটা অন্যায় হয়েছে। কোনো না কোনো সূত্রে বোধহয় আমার বলা উচিৎ ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ওর আবেগ দেখে মনে হলো আমি ওকে আগে না জানিয়ে হয় ওকে গুরুত্ব দেয়া থেকে বঞ্চিত করেছি অথবা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে গুরুত্ব দেইনি-- নিশ্চয়ই এই দুয়ের কোন একটা ভাবছে। আমার যেটা ভালো লাগছে, তাহলো বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ওদের দুজনেরই কৌতূহল আর আবেগ। ছেলের আবেগ আরও পরিণত এবং যথাযথ অবশ্যই যেহেতু সে তার পিতৃভূমিতে সে দশ বছর যাবৎ আছে, ফলে এদেশ এখন তারও। এই দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সে হকদার।

সেই অধিকার থেকেই তার পিতৃগৌরবের অনুভূতিকে পরিপূর্ণ করতে চেয়েছে বলে মনে হয়েছে। আমার ভালো লাগছে ওরা বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব আর অবদান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এখনও জানে না,কিন্তু জানতে চাওয়ার একটা বীজ তো উপ্ত হয়ে আছে। পিতার মধ্য দিয়ে ওরা জাতির পিতাকে অনুভব করতে পারার কোনো শিহরণ হয়তো অনুভব করছে।

লেখক: কবি, অনুবাদক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ঢাকাটাইমস/১০জুলাই/এসকেএস