আম্ফানের ৫০ দিন: পানিতে হাবুডুবু হাজারো মানুষ

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২০, ০৯:৫৭ | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২০, ১০:০০

আব্দুল্লাহ মুয়াজ

ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সুন্দরবন উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে গেছে। এরপর পেরিয়ে গেছে ৫০ দিন। এই সুপার সাইক্লোনের প্রভাবে প্লাবিত এ অঞ্চলের মানুষ এখনো পানিবন্দি। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাদের জীবনযাপন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পানির সঙ্গেই হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে তাদের।

ছোট্ট একটি সিদ্ধান্তই হাজার হাজার মানুষকে ঘরে ফেরাতে পারে। একজন জনপ্রতিনিধি শুধু যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, পানিবন্দি মানুষগুলোকে ঘরে ফেরাবেন, তাহলেই হয়ে যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটুকু নেয়ার মতো একজন মানুষের বড়ই অভাব।

সম্প্রতি খুলনার কয়রা অঞ্চলের একজন জনপ্রতিনিধির ফোনালাপ শুনলাম। একজন অনুসারী ওই নেতাকে ফোন করে বলছেন, ‘আপনি একটু ভাঙায় (ভাঙা বেড়িবাঁধ) যান। আপনি না যাওয়াতে মানুষ সমালোচনা করছে।’ তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আমি কেন সেখানে যাব? আমার সেখানে কাজ কী? ওখানে আমাকে যেতে বলো না।’

অসহায় ওই অনুসারী তাকে বললেন, ‘তবুও এতগুলো মানুষ পানিতে ডুবে আছে, আপনার একটু যাওয়া উচিত।’

কিন্তু ওই জনপ্রতিনিধি আর কানে নেননি অনুসারীর কথা। বরং তাকে নিরাশ করলেন। ধরে নিলাম, ভোটের রাজনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এতগুলো মানুষ ৫০ দিন ধরে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে, তাতেও কি আপনার মন গলল না? মানুষ তো অনেক বড় কিছু চাচ্ছে না। আপনি জনপ্রতিনিধি, আপনাকে পাশে চাচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় বাঁধ বেঁধে ফেলতে পারেন।

বর্ষা মওসুম শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে বর্ষার সময় নদীতে পানি বেড়ে যায়। কয়রা অঞ্চলের ভাঙনকবলিত যে কয়েকটি জায়গায় রিং বাঁধ দেয়া হয়েছে, সেগুলোও খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কিছু জায়গায় জোয়ারের পানি উপচে ভেতরে আসে। প্রশ্ন হলো- যে কাজগুলো স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে করেছে সেগুলো আবার ভেঙে যাক সেটাই কি ওই জনপ্রতিনিধির চাওয়া?

একটি বাঁধের পানি আটকাতে ৫০ দিন সময় লাগে? আমার ধারণা, লাগে না। স্থানীয়রা বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের নোংরা রাজনীতির বলি হচ্ছে লাখো মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারিভাবে এ অঞ্চলের জন্য একটি বাজেট হয়েছে। এই বাজেটের কাজ শুরু হবে নতুন অর্থবছরে। এমনিতেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারি কাজ শুরু হতে দেরি হয়। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের আগে কাজ শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আরো দুই থেকে তিন মাসের আগে কাজ শুরু হবে বলে মনে হয় না। পঞ্চাশ দিন ধরে আটকা মানুষগুলো আরও দু-তিন মাস পানিবন্দি হয়ে থাকবে? এটাই হয়তো তাদের নিয়তি।

গত ২০ মে আম্ফানে তাড়া খাওয়া কয়রা উপজেলার উত্তরবেদকাশী ইউনিয়নের কাটমারচর, হাজতখালী, কাশিরহাট এসব এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা এখনো তাদের ভিটেয় ফিরতে পারছে না। জোয়ারের পানিতে ঘরগুলো ডুবে যায়, আবার ভাটায় জেগে ওঠে। ঘরগুলো নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। এখন তাদের চাওয়া, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই।

কিছুটা উঁচু জায়গার বাসিন্দারা এই পানির মধ্যেই বসবাস করছে। জোয়ারে উঠোন ভর্তি পানি থাকে, ভাটায় পানি সরে যায়। এই সময়ে কাদামাটির সঙ্গেই বসবাস করতে হয় তাদের। তবুও মানুষগুলো ঘর ছাড়ে না। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকা যে কত কষ্টের সেটা তারা জানে।

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর থেকে উপকূলের মানুষের যে দুর্দশা শুরু হয়েছিল, গত ১২-১৩ বছরেও সেটি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এর কারণ ‘টেকসই বাঁধ’ নির্মাণ না হওয়া। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষও নিঃস্ব হয়েছে। ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে বহু মানুষ। প্রিয় জন্মমাটি ছেড়েছেন অনেকে।

এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঘরবাড়ি ফেলে অন্যত্র চলে যাচ্ছে শত শত মানুষ।

অথচ দীর্ঘস্থায়ী, টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য কত শত, হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, নকশা হয়েছে। কত কত প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস পেয়েছেন উপকূলের মানুষ। আর প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ের পর বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের নামে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কত অর্থের অপচয় হয়েছে তার কোনো শেষ নেই।

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ে ভবিষ্যত ঝুঁকি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ (সিইআইপি) গ্রহণ করে। ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ৬৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জমি না পাওয়া, নদী ভাঙনসহ নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়লেও কাজ আর শেষ হয়নি। এ প্রকল্পের আওতাতেই খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।

লেখকঃ সাংবাদিক

(ঢাকাটাইমস/১০জুলাই/মোআ)